যাহারা বংশপরম্পরায় স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস মতাদর্শের রাজনীতির সহিত যুক্ত, তাহারা গত এক দশকে অবস্থা প্রতিকূলে দেখিয়া ভোল পালটাইয়াছে। অর্থাৎ অনুপ্রবেশ করিয়াছে বিভিন্ন দলে। সবচাইতে অধিক অনুপ্রবেশ করিয়াছে ক্ষমতাসীনদের দলে। এই অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে বিগত এক বত্সর ধরিয়া আমরা অসংখ্য রিপোর্ট প্রকাশ করিয়াছি, সম্পাদকীয় লিখিয়াছি; কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কানে সম্ভবত সেই সকল বার্তার কিছুই পৌঁছায় নাই। বলা যায়, অরণ্যে রোদন হইয়াছে, তবু আমরা বলিয়াই যাইতেছি। কারণ উহাই আমাদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব তো পালন করিতেই হইবে। আমরা ইতিপূর্বে বলিয়াছি, স্বাধীনতাবিরোধীরা গোপনে মিশনে আগাইতেছে। তাহারা যেই বিষবৃক্ষের বীজ ক্ষমতাসীনদের জমিনে বুনিয়াছে, সেইগুলি ইতিমধ্যে বড় হইয়াছে। তাহারা এখন অপেক্ষায় রহিয়াছে ঘরে ফসল তুলিবার। ইতিমধ্যেই বড় বড় দল, বিশেষ করিয়া ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদপদবি দখল করিয়া বসিয়া রহিয়াছে রাজাকারদের বংশধরেরা। নির্বাচন যত ঘনাইয়া আসিতেছে, ততই তাহারা একেকটি জেলাকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়াইয়া ধরিতেছে। বহু ক্ষেত্রেই তাহারা যাহা বলিতেছে সেই অনুযায়ীই সকল কিছু হইতেছে।
রাজাকারের বংশধররা অনুপ্রবেশ করিয়া এখন কী কী করা শুরু করিয়াছে তাহার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হিসাবে গতকাল বৃহস্পতিবার ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি খবরের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। ‘নাশকতায় জড়িত অনুপ্রবেশকারীরা’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হইয়াছে—আগুন দেওয়ার ঘটনায় গ্রেফতার করা হইয়াছে ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি নুর উদ্দিন টিপুকে। একই মামলায় ফেনী পৌর যুবদল নেতা মো. রুবেলকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। নাশকতা মামলায় যুবদল নেতার সহিত যুবলীগ নেতা গ্রেফতার হইবার ঘটনা যেন বলিয়া দিতেছে—মতাদর্শের দিক হইতে তাহারা ‘একই বৃন্তে দুইটি ফুল’। যুবলীগের নুর উদ্দিন টিপুর পুরা পরিবার বিরোধী মতাদর্শের রাজনীতির সহিত জড়িত।
বলিবার অপেক্ষা রাখে না, এই রকম কত শতসহস্র টিপু আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করিয়াছে সুযোগ বুঝিয়া ক্ষমতাসীনদের বেকায়দায় ফেলিবার উদ্দেশ্যে। এইদিকে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ছিনতাইসহ অনেক মামলার আসামি, কিশোর গ্যাংয়ের মাস্টারমাইন্ড সোহেল ওরফে ফল সোহেলকে আটক করা হইয়াছে। তাহাকে আটককালে তাহার ৪০/৫০ জন পোষ্য ক্যাডার পুলিশের উপর হামলা করিয়া ছিনাইয়া লইয়া যায়। এলাকায় মাদকের ব্যবসা ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা তাহার নিয়ন্ত্রণে। আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনায় যেই ১১ জনকে গ্রেফতার হইয়াছে, তাহারা ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মী। আসলে তাহারাও অনুপ্রবেশকারী। ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশ করিয়াছে অপরাধ ও নাশকতামূলক কাজ করিবার সুবিধার্থে। ইতিপূর্বে একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়াছে, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের উত্তরসূরিরা এখন অনেক জেলা-উপজেলায় নেতৃত্বে রহিয়াছেন। অর্থের বিনিময়ে তাহারা বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শাখার পদপদবি ক্রয় করিয়াছেন। হইয়া উঠিয়াছেন বড় নেতাদের ঘনিষ্ঠ। ইহার পাশাপাশি এই সকল পদবি ব্যবহার করিয়া স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চাকুরিতে নিয়োগসহ ব্যবসায়-বাণিজ্য, ঠিকাদারি—সকল কিছু নিজেদের আয়ত্তে লইয়াছেন। মাদক ব্যবসায় জড়িত তাহাদেরই সিন্ডিকেট। এই সকল বিরোধী মতাদর্শীরাই দলীয় পরিচয় ব্যবহার করিয়া দুর্নীতি, চোরাচালান, জমি দখল, নিয়োগ, বদলিবাণিজ্য, টিআর-কাবিখা প্রকল্পে লুটপাটসহ নানা কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা পালন করিতেছে।
দুঃখজনকভাবে এই স্বাধীনতাবিরোধী অনুপ্রবেশকারীদের দাপটে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ও ত্যাগী নেতারা হইয়া পড়িয়াছেন একলা। দলীয় ফোরামের একাধিক বৈঠকে ত্যাগী নেতারা এই অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে নানা তথ্য তুলে ধরিলেও কোনো প্রতিকার হয় নাই। বরং যাহারা তাহাদের এই সকল পদপদবি দিয়াছেন তাহারাই অনুপ্রবেশকারীদের রক্ষা করিয়া যাইতেছেন। আমরা অনেক বার বলিয়াছি, বিষবৃক্ষ কখনো সুমিষ্ট ফল দিতে পারে না। বিষবৃক্ষদের আর কবে সামলানো হইবে? কত শত টিপু অপরাধ করিয়া ধরা পড়িবার পর টনক নড়িবে?