মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নিজের সীমানা ও সীমাবদ্ধতা জানিতে হইবে

আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:৩০

আমরা ডিসকভারি চ্যানেলে ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’-এ বেয়ার গ্রিলসের অনেক দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড দেখিয়াছি। যদিও সেই সকল পর্বের শুরুতে সতর্কীকরণে বলা থাকে, বন্য বা প্রতিকূল পরিবেশে ঐ রকম দুঃসাহস না দেখাইতে। ঐ প্রোগ্রামগুলি করা হইয়াছে এক্সপার্টদের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করিয়া। কিন্তু যুগটা এখন টিকটক, ইউটিউবের শর্টস এবং ফেসবুকের রিলস-এর। ইহার সহিত নিজেকে দুঃসাহসিক করিবার একটি অদম্য এবং নির্বোধ মানসিকতা তো রহিয়াছেই। তাহারই কিছু উদাহরণ আমরা দেখিতে পাই অপরিণামদর্শী অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় কিছু তরুণের মধ্যে। গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, চলতি বত্সরের অক্টোবর মাসের ৩১ দিনে সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ৪৬৪টি দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। এই সকল দুর্ঘটনায় ৫০২ জন নিহত ও ৮৩৮ জন আহত হইয়াছেন। ইহার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হইয়াছে ৪৩৭ জনের, যাহাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই মোটরবাইক-আরোহী বলিয়া জানা গিয়াছে। দেখা যাইতেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার এই সংখ্যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩১ শতাংশ, আর মৃত্যুর দিক হইতে ৩৩ শতাংশ। মোটরবাইক দুর্ঘটনার কারণ সকল ক্ষেত্রেই নিশ্চয়ই বেপরোয়া গতিতে বাইক চালনা নহে, তবে অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় নতুন প্রজন্ম বহু ক্ষেত্রেই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া গতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।

কেবল মোটরবাইক নহে, টিকটক, ইউটিউবের শর্টস এবং ফেসবুকের রিলসের জন্য অবিশ্বাস্য দৃশ্যধারণের আকাঙ্ক্ষায় অনেক বড় ঝুঁকি লইয়া নতুন প্রজন্মের কিছু ছেলেমেয়ে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে পড়েন, যেমন—গত ঈদুল আজহায় বৈরী আবহাওয়া সত্ত্বেও সিলেটের ভোলাগঞ্জে ‘সাদা পাথর’ দেখিতে ভিড় করিয়াছিল ঈদের ছুটি উপভোগ করা মানুষজন। ধলাই নদীর বুকে ছড়াইয়া-ছিটাইয়া থাকা পাথরের শুভ্র বিছানা আর মেঘালয় হইতে নামিয়া আসা ঝরনার পানির তীব্র স্রোত দেখিতে কয়েক হাজার পর্যটক ভিড় জমাইয়াছে সেইখানে। ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ জন শিক্ষার্থী সাদা পাথর এলাকার পানিতে গোসল করিতে নামিলে প্রচণ্ড স্রোতে জুনাইদ আহমদ পানির নিচে তলাইয়া গিয়াছিল। জায়গাটি যে সাঁতারের জন্য বিপজ্জনক, তাহা লইয়া সন্দেহ নাই। ইহার পর গত ঈদুল আজহায় পুনরায় ঐ এলাকায় একইভাবে মৃত্যু হইয়াছে ঢাকার মিরপুরের আবদুস সালামের।

বিপদ কেবল এই সকল পাহাড়ি এলাকাতেই নহে, আমরা দেখিয়াছি সমুদ্রস্নানে নামিয়া অনেকেরই হুঁশ থাকে না—উহা জোয়ারের সময়, নাকি ভাটার সময়। জোয়ারের সময় জলে নামাটা বিপদের নহে, কিন্তু ভাটার সময় চোরা স্রোত বহিয়া যায়, তখন পানিতে নামিবার পরিণাম মারাত্মক হইতে পারে। সমুদ্রে পানিতে নামা বিপদের, নাকি নিরাপদ—তাহার জন্য লাল বা সবুজ পতাকা টানানো থাকে। অন্যান্য পর্যটন এলাকাতেও বিপদের পরিবেশ ও পরিস্থিতি বুঝিয়া এই ধরনের বিপত্সংকেত-সংবলিত পতাকা ও নোটিশ ঝুলাইয়া রাখিবার নিয়ম রহিয়াছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয় না, আবার অনেকেই বুঝিতে পারে না, কোথায় সাঁতার কাটা যায় আর কোথায় যায় না। মোটরবাইকের ক্ষেত্রেও সড়ক-মহাসড়ক অনুযায়ী গতি নির্ধারণ করিয়া দেওয়া থাকে, কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই তারুণ্যের টগবগে মন গতির মোহে আচ্ছন্ন হইয়া দুর্ঘটনা ঘটাইয়া ফেলেন। তাহাতে পঙ্গুত্ব কিংবা মৃত্যু ঘটে বহু মানুষের। কেবল অক্টোবরের একটি মাসের পরিসংখ্যানই তাহার প্রমাণ।

এই জন্য আমাদের মহামতি সক্রেটিসের সেই সারসত্য সর্বদা স্মরণ করিতে হইবে—নিজেকে জানো। নিজেকে জানিলে নিজের সীমানা ও সীমাবদ্ধতাও জানা যায়। সুতরাং নিজের সীমানা ও সীমাবদ্ধতা জানিবার মাধ্যমে রক্ষা করিতে হইবে না জানা নিজেকে।

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন