মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

উন্নয়নশীল বিশ্বে সত্য বলিয়া কিছু নাই!

আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০৪:০০

পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রবীণ ও বিজ্ঞ রাজনীতিবিদগণের হতাশ হইবারই কথা। বিশেষ করিয়া উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি সত্যেরও পরিবর্তন হয়। তখন ইতিপূর্বে যে বিষয় সম্পর্কে যখন যাহা বলা হইয়াছিল তাহার উলটাটা বুঝিতে হয়। আমরা কী অবস্থায় রহিয়াছি—এই প্রশ্নের জবাবে একজন উঠতি বয়সি ছাত্রেরও তখন উত্তর হয় অন্যরকম ও কৌশলী। তখন তাহাকে যাহা শিখানো হইয়াছিল তাহার উলটাটা জানিতে ও পড়িতে হয়। কারণ এই সমস্ত দেশের প্রসেস অব লার্নিং বা শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যেই গলদ রহিয়াছে। এই জন্য রাজনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি তাহাদের নূতন কথা বলিতে হইবে ইহাই সত্য। তাই এই সকল দেশে আসলে সত্য বলিয়া কিছু নাই!

পৃথিবীতে প্রতিদিন সূর্যোদয় হয়। আর আমরা প্রতিদিন শপথ নেই যে, আমরা ভালো হইয়া চলিব। বাল্যকালে আমরা শিখিয়াছি কবির সেই কালজয়ী উচ্চারণ, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।’ এখানে প্রতিদিন ভালো হইয়া চলিবার কথা আসিতেছে কেন? তাহার মানে আমরা ভালো হইয়া চলিতে পারি না। ভালো হইয়া চলাটা কঠিন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকারে পরিবর্তন আসিবে, নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হইবে—ইহাই স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক দেশে নেতৃত্বের বাছাই প্রক্রিয়া সকলের অংশগ্রহণমূলক হয়। আর ইহার মাধ্যমেই আসে সেই পরিবর্তন; কিন্তু পৃথিবীতে এমন সকল দেশও আছে, যেইখানে নেতৃত্বের এই বাছাই প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ ও অ-অংশগ্রহণমূলক। যদি বলা হয়, সেই বাছাই প্রক্রিয়ায় কেহ আসিল কি আসিল না, তাহা কোনো ব্যাপার নহে, যাহারা ভোট দিবেন তাহারা ভোটার না হইয়া কেবল মানুষ হইলেও চলিবে, তাহা হইলে সেই প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন থাকিয়াই যাইবে। কোনো কোনো দেশে বিশেষসংখ্যক লোক সেই বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশ না নিলে তাহা গ্রহণযোগ্যই হয় না, বরং আবার ভোটাভুটিতে যাইতে হয়; কিন্তু দুর্ভাগ্য হইল, জনমতের এমন সুন্দর ব্যবস্থার কথা আমরা বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশে শুনিতে পাই না। অন্তত ৫০ শতাংশ ভোট না হইলে পুনরায় ভোট হইতে হইবে—এমন ব্যবস্থা দেখিয়া যাইতে পারিলে অনেকে জীবনসায়াহ্নে আসিয়া হইলেও মনে প্রশান্তি লাভ করিতেন।

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ব্যবস্থায় আমরা শিখিয়াছিলাম, যে দল অধিক সম্মতি পাইবে, তাহারাই ক্ষমতার অধিকারী হইবে। ইহাতে উন্নয়নশীল দেশেও তেমন কোনো সমস্যা হইবার কথা ছিল না; কিন্তু এই সমস্ত দেশ যখন কোনো বৃহত্তর শক্তির বন্ধু হইয়া যায়, তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। শুরু হয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। ইহা মিটাইতে হেন কোনো দেশ নাই, যাহারা মধ্যস্থতা করিতে আসেন না; কিন্তু তাহারা যত বারই মধ্যস্থতা করিবার জন্য আসেন কিংবা ইহার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন, তত বারই তাহাদের ব্যর্থ হইতে দেখা যায়। অবশেষে এই সকল শুভাকাঙ্ক্ষ্মী সেই দেশের জনগণের সিদ্ধান্তকেই শেষ সিদ্ধান্ত হিসাবে মানিয়া লন। তাহারা অবাধ, মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেন; কিন্তু ভয়ভীতি প্রদর্শন, সন্ত্রাস ও অবৈধ অর্থের ছড়াছড়ি ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠিয়া ভোটাররা যাহাতে নির্ভয়ে তাহাদের সিদ্ধান্ত লইতে পারেন, তাহার নিশ্চয়তা কোথায়?

এই পরিস্থিতিতে সেই সকল প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানী-গুণীজন আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকেন। সন্ধ্যায় ধ্রুবতারা যখন উঠিতে থাকে, তখন তাহারা তাহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া ভাবিতে থাকেন, ভোট সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হইল কি না, তাহার সিদ্ধান্তটি কে দিবেন? উন্নত দেশে যে সমস্ত পন্থায় এই বাছাই প্রক্রিয়া চলে, এই প্রক্রিয়ার কথা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে কেহ শুনেন নাই ও দেখেন নাই। তাহার বাস্তবায়ন কীভাবে হইবে? যাহারা বলেন, যেই দেশে বাছাই সেই দেশ সিদ্ধান্ত লইবে; কিন্তু সেই বাছাই কীভাবে করিতে হইবে? প্রথমে যেই সকল বিদেশি পর্যবেক্ষক আসেন তাহারা খোলা মনেই আলোচনা করেন; কিন্তু তাহাদের খোলা মনের সিদ্ধান্ত ছিল কি না, তাহা আমাদের জানা নাই। নির্বাচন যখন ঘনাইয়া আসে, তখন তাহাদের নানা এজেন্ডা বাস্তবায়নের কথা শোনা যায়। এমনিতেই এই সকল দেশে নির্বাচন করা এক কঠিন ও জটিল বিষয়। আধা সামন্তবাদী সমাজের কারণে দেখা যাইবে তাহাদের এজেন্ডা বাস্তবায়িত হয় নাই।

অতএব, এই সকল দেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করিতে হইলে সকলের পূর্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করিতে হইবে। সর্বোপরি ভোটারদের শিক্ষাদীক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও সক্ষম করিয়া তুলিতে হইবে। কেননা, যাহারা নিজেরা পক্ষ নির্ধারণ করিতে পারেন না, বরং আর্থিক বিনিময় বা ভয়ভীতি দ্বারা প্রভাবিত হন, তাহারা সঠিকভাবে নেতৃত্ব বাছাই করিবেন কীভাবে?

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন