উন্নয়নশীল বিশ্বের বাস্তবতায় দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ দুুর্নীতিবাজ ও অযোগ্যদের নির্বাচনে জয়ী হইবার পরিকল্পনার কথা বলিয়াছেন। এই সকল দেশে নির্বাচনের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নানা অঘটন ও তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়া থাকে, যাহা মানিয়া লওয়া কঠিন। সংঘাত-সংঘর্ষ তো আছেই, তাহার উপরে কালোটাকার ছড়াছড়ি দেখিয়া বিবেকবান যে কোনো ব্যক্তি দেশের ভূতভবিষ্যত্ লইয়া আতঙ্কিত না হইয়া পারেন না। ভোটের সময় আসিলে এই সকল দেশে মাদকের কারবারসহ নানা অবৈধ উপায়ে রাতারাতি বড়লোক হইয়া নেতা বনিয়া যাওয়া একশ্রেণির অযোগ্য-অরাজনৈতিক লোকের দৌরাত্ম্য বাড়িয়া যায়। নির্বাচনের সময় তাহারা গুনিয়া নহে, বরং ‘দাঁড়িপাল্লায় মাপিয়া’ অর্থ ব্যয় করেন। উদ্দেশ্য একটাই—এই বিনিয়োগের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি হইয়া রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়া দুই হস্তে অর্থ কামাই করা। ইহা কি দেখিবার কেহ নাই? দুর্নীতি দমন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগ প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাকের ডগায় তাহারা এই সকল অপকর্ম করিলেও তাহাদের কোথাও জবাবদিহি করিতে হয় না।
উল্লেখ্য, এই সকল দেশে অনেক সময় জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলিতে সর্বোচ্চ কত টাকা ব্যয় করা যাইবে তাহার একটি সীমারেখা নির্ধারণ করিয়া দেওয়া হয়; কিন্তু বড়ই আশ্চর্য ও পরিতাপের বিষয় হইল, ইহার সীমা লঙ্ঘন করিয়া নির্বাচন উপলক্ষ্যে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করা হইলেও কাহাকে কোথাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়িতে হয় না। আমাদের জানামতে, বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদে সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ, পৌরসভায় সাড়ে ৫ লক্ষ এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৫ লক্ষ টাকা খচর করা যায়। নির্বাচনি এলাকার জনসংখ্যাভেদে ইহা কিছুটা কমবেশি হইতে পারে; কিন্তু কোটি কোটি অর্থ খরচ করা হয় কীভাবে? একটি পৌরসভায় যেইখানে ৪০ কোটিরও অধিক অর্থ খরচ করিবার অভিযোগ আসে, সেইখানে এমপি পদে ইলেকশনে কত অর্থ ব্যয় করা হয় তাহা সহজেই অনুমেয়। এই পরিস্থিতিতে এমন নিয়মের অস্তিত্ব থাকাটা কি হাস্যকর নহে? তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে নির্বাচন উপলক্ষ্যে এই অতিরিক্ত খরচের রীতি চলিয়া আসিতেছে যুগ যুগ ধরিয়া; কিন্তু এই অর্থের উৎস কখনো অনুসন্ধান করা হয় না। ইহার স্বচ্ছতা লইয়া তেমন প্রশ্ন উঠে না। এই প্রবণতা বন্ধে নির্বাচন কমিশনের কি কিছুই করিবার নাই?
নির্বাচন উপলক্ষ্যে এই বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয় কোন কোন খাতে? মূলত স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করিতেই ইহার একটি বড় অংশ ব্যয় হয়। ইহার পর অর্থ খরচ করা হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউপি কিংবা পৌরসভা চেয়ারম্যান-মেম্বার, দলের নেতাকর্মী এবং অন্যান্য বিভাগের লোকজনকে খরিদ করিবার কাজে। মোটা অর্থ ব্যয় হয় সমমনাদের খানাপিনা তথা ভোজনবিলাসে। এমনও নামধারী সম্ভাব্য প্রার্থীর উদয় ঘটে, যাহারা স্থানীয় পর্যায়ের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ গোটা দলকেই কিনিয়া লয় অর্থের বিনিময়ে। এইভাবে নির্বাচনের সময় একশ্রেণির উঠতি নেতা, পাতিনেতার নিকট অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হইয়া যায় পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচনি কর্মকর্তা এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে স্পর্শকাতর কোনো কোনো বিভাগ। ইহার সত্যাসত্য লইয়া প্রশ্ন উঠিতে পারে; সেই ক্ষেত্রে আমরা বলিতে চাহি, যদি ঘটনা মিথ্যা হয়, তাহা হইলে নির্বাচনের পূর্বে অতি তুচ্ছ অভিযোগের ভিত্তিতে অন্য দলের নেতাকর্মীকে পুলিশ তুলিয়া লইয়া যাইতেছে কেন? কোর্টে তাহাদের জামিনও মিলিতেছে না। এইভাবে কি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব? নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণির উঠতি নেতার দ্বারা নির্বাচনি এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরা তছনছ করিবার বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার নিকট অভিযোগ করিয়াও তাহার বিচার হয় না কেন? নির্বাচনের একেবারে সন্নিকটে আসিয়া অযাচিতভাবে নির্বাচনি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের ঘটনাই-বা কীভাবে ঘটে? ইহা লইয়া কোর্ট-কাচারিতে গেলেও মেলে একই ফল। এই সমস্ত দেশে এমন আইনও পাশ হয়, যাহা সংবিধানের ঊর্ধ্বে। কী অদ্ভুত কথা! অতএব, উন্নয়নশীল দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলা যত সহজ, বাস্তবায়ন করা তত সহজ নহে।