‘যাহারা শুদ্ধ বিশ্বাস লইয়া সামনে আগাইয়া যায়, তাহারা একদিন সবকিছুই ঠিক হইতে দেখে’—মার্কিন ধর্মীয় বক্তা ও লেখক গর্ডন হিংকলির এই কথা মিথ্যা নহে। ২০১৬ সালে একটি সেতু নির্মাণের আহ্বান জানাইয়া প্রধানমন্ত্রী বরাবর পত্র লিখিয়াছিল শুদ্ধ, সফেদ বিশ্বাসে বলীয়ান ছোট্ট শিশু শীর্ষেন্দু। গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেতু নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়া শীর্ষেন্দুর এই মহৎ কর্মস্পৃহা বাস্তবতার মুখ দেখিয়াছে। দৈনন্দিন চলার পথে এই ধরনের সংবাদ আমাদের সাহস-শক্তি জোগায়। ভালো, সত্, মহত্ কর্মে আত্মোত্সর্গে অনুপ্রাণিত করে।
শীর্ষেন্দু তাহার চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে লিখিয়াছিল, মির্জাগঞ্জে পায়রা নদী পারাপারে চরম ভোগান্তি পোহাইতে হয়। নদীটিতে প্রচণ্ড ঢেউ থাকে। ফলে অনেক সময় নৌকা বা ট্রলার ডুবিয়া অনেকে মারা যায়, অনেক সন্তান পিতৃমাতৃহীন হয়। চিঠিতে শীর্ষেন্দু ইহাও জানায়, সে তাহার পিতামাতাকে ভালোবাসে এবং কোনোভাবেই তাহাদের হারাইতে চাহে না। এই জন্য নদীর উপর একটি ব্রিজ বা সেতু নির্মাণের ব্যবস্থা করিতে প্রধানমন্ত্রীর নিকট সনির্বন্ধ অনুরোধ জানায় চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী। চিঠির জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শীর্ষেন্দুকে লিখিয়াছিলেন, পায়রা নদীটি অত্যন্ত খরস্রোতা, যাহা তাহারও জানা এবং নদীটির বিষয়ে শীর্ষেন্দুর এই সচেতনতা তাহাকে মুগ্ধ করিয়াছে। শীর্ষেন্দুকে প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করিয়াছেন এই বলিয়া, ‘মির্জাগঞ্জের পায়রা নদীতে একটি সেতু নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে বলিয়া তোমাকে আশ্বস্ত করিতেছি।’ এই ধারাবাহিকতায় বঙ্গভবন হইতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সেতু নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বলা বাহুল্য, ইহার মধ্য দিয়া কেবল শীর্ষেন্দুর চাওয়াই পূরণ হয় নাই, বরং দক্ষিণ জনপদের লক্ষ লক্ষ মানুষ আনন্দে আত্মহারা স্বপ্নের সেতু পাইয়া। শীর্ষেন্দুর মহৎ কর্মোদ্যমে আপ্লুত, আনন্দিত আমরাও। ইহা তো মহাকাব্যিক অধ্যায়!
বাস্তব কথা হইল, সঠিকভাবে মূল্যায়িত হইলে নেহাত ক্ষুদ্র দাবিও ‘মহৎ দাবি’ হইয়া উঠে। আজ আব্রাহাম লিংকনের দাড়িভর্তি মুখের যেই ছবি দেখি আমরা, তাহার পিছনের কাহিনি কয়জনে জানে? একটি ছোট্ট শিশু তাহাকে পত্র লিখিয়াছিল এই বলিয়া যে, ‘প্রিয় আব্রাহাম, আমি তোমাকে খুবই ভালোবাসি, পছন্দ করি; কিন্তু তোমার মুখ অনেকটা ভাঙা, চাপা ধরনের!’ আব্রাহাম লিংকন ছোট্ট শিশুর কথাকে ফেলাইয়া দেন নাই! চিন্তাভাবনা করিয়া দেখেন, আসলেই তো—শিশুটির কথাই সঠিক। সুতরাং শুরু করেন দাড়ি রাখা।
ইতিহাসের পাতায় পাতায় এই ধরনের অগণিত ঘটনা রহিয়াছে। এমনও অনেক ক্ষেত্রে ঘটিয়াছে, দাবি পূরণে দেশের রাজা-বাদশা, শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ ছুটিয়া আসিয়াছেন অতি সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়! এই সকল দৃষ্টান্ত আমাদের কী শিক্ষা দেয়? ইহার মর্মার্থ হইল, চাওয়া-পাওয়া তথা প্রত্যাশা যদি যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়, তাহা হইয়া উঠে মহামূল্যবান, মহোত্তম। তবে প্রত্যাশা বা দাবি অবশ্যই ন্যায়সংগত ও যুক্তিযুক্ত হইতে হইবে। মহৎ, সৎ কর্ম করিবার পথে বয়স কখনই প্রতিবন্ধক হইতে পারে না—শিশু শীর্ষেন্দু ইহার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। মহৎ কাজ করিতে যেই জিনিসটি অধিক প্রয়োজনীয়, উহা হইল ‘মনের জোর’। এই জোর সকলের থাকে না, যাহারা এই বিশেষ গুণ আত্মস্থ করিতে পারেন, তাহারা হইয়া উঠেন ‘আলোর দিশারি’।
এই অর্থে বলিতে হয়, ভালো, মহত্ কাজে আমাদের আত্মনিয়োগ করিতে হইবে। প্রিয় নবিজি (সা.) তাহার কথা ও কাজের মাধ্যমে অন্যকে ভালো কাজে উত্সাহিত করিতেন। তিনি বলিয়াছেন, ‘আল্লাহ তাআলা উঁচু ও মহৎ কাজ এবং সত্ মানুষকে পছন্দ করেন এবং নিকৃষ্ট কাজ অপছন্দ করেন।’ (সুনানে তাবরানি, হাদিস: ২৮৯৪)। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যেমনটি বলিয়াছেন—‘যদি উড়িতে না পারো, তবে দৌড়াও; যদি দৌড়াইতে না পারো, তবে হাঁটো; হাঁটিতে না পারিলে হামাগুড়ি দাও। যে অবস্থাতেই থাকো, সামনে চলা বন্ধ করিও না’।