মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নতুন কারিকুলামে মানিয়ে নেওয়াই চ্যালেঞ্জ!

আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ০৪:৪৫

‘বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ, জীবনের সঙ্গে সমপর্কহীন বিদ্যা পঙ্গু!’ মুখস্থনির্ভর বিদ্যায় পরীক্ষার আধিক্যে প্রতিবছর জিপিএ ফাইভের জোয়ার চলছেই। পাশাপাশি ক্লাসে একজন প্রথম হওয়ার জন্য সব শিক্ষার্থীর ওপর যে নির্যাতন চলে তা পরিমাপের যন্ত্র এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। মাঝখান থেকে গাইড কোম্পানি, প্রাইভেট-কোচিংয়ের রমরমা বাণিজ্য অভিভাবকের পকেট ফাঁকা করে দিচ্ছে বানের জলের মতো। তাছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লব তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এসে গতানুগতিক শিক্ষায় উটপাখির ভূমিকায় থাকাটা আত্মঘাতী। পেশার ধরন ও বৈচিত্র্য পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। বাস্তবতার নিরিখে সরকার শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে আংশিকভাবে চালু করা নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে কিছু সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। আশা করা যায়, আগামী বছরের বিস্তৃত পরিসরে পাঠ্যবইগুলো হবে আরো পরিমার্জিত। প্রচলিত পরীক্ষার বাইরে সমস্যা সমাধান নির্ভর অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনে দক্ষতা প্রতিফলিত মূল্যায়ন কার্যক্রম হবে আরো পরিশীলিত।

শ্রেণিকক্ষের বাইরে গিয়ে প্রকৃতি ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা পাওয়ার সুযোগটি শিক্ষার্থীরা নিয়েছে বিপুল উত্সাহ ও আনন্দের সঙ্গে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ-আনন্দ আর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ খুবই ইতিবাচক। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা রয়েছে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়ের বাইরে প্রতিটি শিক্ষার্থী থাকবে অভিভাবকদের স্নেহ পরবশ তত্ত্বাবধানে। যেখানে অভিভাবকদের উদাসীন থাকার সুযোগ নেই। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী নতুন শ্রেণি রুটিন ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ও শিক্ষকদের ভূমিকায়ও আসছে পরিবর্তন। বক্তব্যনির্ভর পাঠদান থেকে বেরিয়ে  শিক্ষকের ভূমিকায় কখনো তিনি সহযোগী শিক্ষার্থী আবার কখনো মেন্টর। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকগণ হয়ে উঠছেন দক্ষ। টিচার্স গাইড শিক্ষককে প্রতিমুহূর্তে দেখিয়ে দিচ্ছে করণীয় ও পথ নির্দেশনা। প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা সাপেক্ষে সার্বিক সহযোগিতা দিতে হচ্ছে।

নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে নতুন কারিকুলামে। অভিভাবকদের অংশগ্রহণে শিক্ষা কার্যক্রম হবে আরো অংশগ্রহণমূলক ও প্রাণবন্ত। শ্রেণিকক্ষের বাইরেও যে শিক্ষার বিশাল উত্স রয়েছে তার সঙ্গে শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটছে প্রতিনিয়ত। সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ আবশ্যক হয়ে গেছে নতুন কারিকুলামে। শিক্ষার্থীর বিশেষ আগ্রহ ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে এই কারিকুলাম। কারিগরি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাছাইকৃত সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোকেশনাল শাখার সংযোজন শিক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি লার্নিং সেন্টার, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ও স্কুল অব ফিউচার শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত শিক্ষার ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী প্রচলিত পরীক্ষা না থাকায় গাইড বই এবং প্রাইভেট-কোচিংয়ের কোনো প্রয়োজনই নেই। শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে শিক্ষকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। যেখানে প্রতিটি পর্যায়ে পরিমাপ হবে দক্ষতা স্তর। এক্ষেত্রে শিক্ষকগণ বিচারকের ভূমিকায় থাকবেন নৈতিকতার উত্কর্ষে। অতিমূল্যায়ন অথবা অবমূল্যায়নের সুযোগ নেই। সতীর্থ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক—এই তিন পক্ষের মূল্যায়নে নৈতিকতার পরীক্ষা ও প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। অ্যাপসের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হবে সকল মূল্যায়নের রেকর্ড। বছরব্যাপী মূল্যায়নে ঘাটতি চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ হবে সহজ। দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে নির্দিষ্ট যোগ্যতা অর্জনে রাখবে যথাযথ ভূমিকা।

নতুন কারিকুলামের সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষা প্রশাসনের নিবিড় মনিটরিং ও মেন্টরিং অপরিহার্য।  নতুন কারিকুলামে নেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা; রয়েছে অফুরান অমূল্য সহযোগিতা ও সম্ভাবনা। কিন্তু আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা (অধিকাংশ অভিভাবকদের উদাসীনতা ও একশ্রেণির অভিভাবকের অতিরিক্ত উদ্বেগ, প্রাইভেট, কোচিং, অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা, পড়ার চাপ প্রভৃতির সমষ্টি লোভনীয় ফলাফলও একটি বিশেষ অপতত্পরতা) থেকে বের হয়ে আসতে কিছুটা সময় লাগবে। দ্রুত নতুন কারিকুলামে সব পক্ষের মানিয়ে নেওয়াটাই চ্যালেঞ্জ। ঐতিহাসিকভাবে আমরা সকল চ্যালেঞ্জ জয় করা জাতি।

লেখক: গবেষণা কর্মকর্তা, সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন