মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সেই নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়

আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৫:৩০

প্রেসিডেন্ট বুশের মতো চার্চিলের বক্তব্যকেও ‘ঐতিহাসিক প্রসংশনীয় বক্তৃতা’ না বলে উপায় নেই। এসব বক্তৃতা বিশ্ববাসীর জন্য যেসব প্রতিশ্রুতির কথা শুনিয়েছিল, তা কিছু সময়ের জন্য হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছিল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মনে

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে আমেরিকার বিজয়ের পর প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়রের এক ঘোষণায় বিশ্বশান্তির আভাস মিলেছিল। ১৯৯১ সালে কংগ্রেসে ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণে বুশ বলেছিলেন, ‘এমন এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার যুগে প্রবেশ করছি আমরা, যেখানে দুর্বলের ওপর সবলের আগ্রাসন বন্ধের কথা মাথায় রেখেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টা আবর্তিত হবে।’ আজ ফিলিস্তিনের গাজায় যে অবস্থা চলছে, তাতে করে বুশের ভবিতব্যের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। শুধু গাজার ঘটনা কেন, ঐ সময়ের পর এমন বহু ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে বলতে গেলে বুশের প্রতিশ্রুতি সমালোচনার মুখে পড়ে যাবে।

পণ্ডিতেরা বলে থাকেন, মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে নতুন নতুন সংঘাতের ঘটনা ঘটে এবং তারপর বুশের মতো করেই প্রতিশ্রুতি আসে নেতাদের মুখ থেকে। এটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে! বুশ এমনও বলেছিলেন, ‘সব পক্ষের উদ্দেশ্যে পরিষ্কার বার্তা—মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব থেকে জরুরি বিষয় হলো সমঝোতা। একমাত্র সমঝোতাই পারে এই অঞ্চলে সবার জন্য শান্তি বয়ে আনতে। সব পক্ষের উপকার হতে পারে কেবল পারস্পরিক সমঝোতার রাস্তায় হাঁটার মধ্য দিয়ে।’

বুশের পরের কথা ছিল, ‘ইসরাইল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কিংবা ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার দীর্ঘদিনের ব্যবধান-বৈষম্য ঘোচাতে আমাদের সব ধরনের চেষ্টা করে যেতে হবে। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদের রাস্তা তো পরিহার করতেই হবে। ... এবং এসব ক্ষেত্রে কূটনীতির বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না।’

বুশের পরের কথাগুলো ছিল আরো প্রশংসনীয়। তার ভাষায়, ‘শান্তির পশ্নে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজল্যুশন ২৪২ ও ৩৩৮ অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। শান্তি ভূখণ্ডের নীতিও (দ্য প্রিন্সিপাল অব টেরিটরি ফর পিস) গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব ক্ষেত্রে বাস্তবিক অর্থেই শান্তির ওপর জোর দেওয়া আবশ্যক। ইসরাইলের নিরাপত্তা ও স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়ের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের বৈধ রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে এসব আইন ও নীতির সঠিক প্রয়োগ সব পক্ষের জন্য খুলে দেবে শান্তির দরজা। অন্য যে কোনো পথ ন্যায্যতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ না-ও করতে পারে, কিন্তু এগুলো অব্যর্থ ওষুধ—কোনো সন্দেহ নেই। আরব-ইসরাইল সংঘর্ষের অবসান ঘটাতে চাইলে এগুলোর বাস্তব প্রয়োগের সঠিক সময় এটাই।’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বক্তব্য শেষ করেন এই বলে, ‘আজ আমরা এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে। এই বিশ্ব এমন ব্যবস্থার অবতারণা করবে, যা সত্যি সত্যিই বয়ে আনবে অমিয় সব সম্ভাবনা।’

বুশের আগে এ নিয়ে কথা বলেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। তার ভাষায়, ‘একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা আসতে চলেছে, যেখানে ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমাধান ঘটবে সবকিছুর... এই ব্যবস্থা শক্তিশালীদের বিরুদ্ধে শক্তিহীনদের রক্ষায় রক্ষাকবচ হয়ে উঠবে...’। চার্চিল এ-ও বলেছিলেন, ‘এমন এক বিশ্ব গড়ে উঠতে চলেছে, যেখানে স্নায়ুযুদ্ধোত্তর অচলাবস্থা থেকে বিশ্ববাসীকে মুক্তি দিতে জাতিসংঘ অনেক কিছু করার সুযোগ পাবে।’ চার্চিল শেষ করেছিলেন এভাবে, ‘এমন এক বিশ্ব আমরা দেখতে চলেছি, যেখানে স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে সব জাতি সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে। এই বিশ্বে নিজের জন্য একটি করে আবাস খুঁজে পাবে সবাই।’

 প্রেসিডেন্ট বুশের মতো চার্চিলের এই বক্তব্যকেও ‘ঐতিহাসিক প্রসংশনীয় বক্তৃতা’ না বলে উপায় নেই। এসব বক্তৃতা বিশ্ববাসীর জন্য যেসব প্রতিশ্রুতির কথা শুনিয়েছিল, তা কিছু সময়ের জন্য হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছিল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মনে। কারণ, স্নায়ুযুদ্ধের মেরুকরণের রাজনীতির অবসান হতে চলেছে—এমন কথা প্রচার পেতে থাকে নেতাদের মুখে এ ধরনের বক্তব্য শোনার পর।

উল্লেখ না করলেই নয়, বুশ সিনিয়র কেবল কথার কথা বলেই চুপ মেরে যাননি, বরং উদ্যোগও নেন কিছু ক্ষেত্রে। শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে মাদ্রিদ শান্তি সম্মেলনের (মাদ্রিদ পিস কনফারেন্স) ডাক দেন তিনি। এই ধারাবাহিকতায় পিএলও (প্যালেস্টাইনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন) ও ইসরাইলের মধ্যে শুরু হয় আলোচনা। এরপর ১৯৯৩ সালে ঐতিহাসিক অসলো চুক্তিতে (ওয়াশিংটন অ্যাকর্ডস) স্বাক্ষর করে পক্ষগুলো। পরবর্তী সময়ের ইতিহাস নিশ্চয় সবার জানা—শান্তি নেমে এসেছিল সত্যিকার অর্থেই।

বুশ সিনিয়র কাজ করে দেখিয়েছিলেন বটে, কিন্তু পরের ঘটনাগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত। বুশ সিনিয়রের পুত্র জর্জ ডব্লিউ বুশের হাত ধরে আবারও বিশ্ব যাত্রা করে পেছনের দিকে! পিতার শান্তি প্রচেষ্টার পথে হাঁটেননি জুনিয়র বুশ। তার শাসনাধীনে বিশ্ব দেখে ‘এক নতুন আমেরিকা’কে, যেখানে মার্কিনদের দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল ভিন্ন ধরনের!

জুনিয়র বুশের জমানায় দুই দুটি বৃহত্তর যুদ্ধের সাক্ষীতে পরিণত হয় বিশ্ব। বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দাদের ওপর নেমে আসে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়, বুশের আমলে মধ্যপ্রাচ্য কখনোই যুদ্ধের ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। বিভিন্ন ইস্যুতে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে লেপ্টে যায় সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিভাজনের কালো দাগ। অথচ শতাব্দীর পর শতাব্দী এই অঞ্চল সহনশীলতা ও সহাবস্থানের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে আসছে।

বুশ জুনিয়র যে খেলা শুরু করেন মধ্যপ্রাচ্যের ভূখণ্ডে, তাতে আমেরিকার যে খুব লাভ হয়েছে, এমন কথা মোটেও সত্য নয়। কারণ, মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা ততটা দাপট দেখাতে পারেনি, যতটা আন্দাজ করেছিলেন বুশ। আমরা দেখে আসছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই একমাত্র পরাশক্তি ছিল না, বরং বিশ্বের অন্য বৃহত্তম সামরিক শক্তির সঙ্গে লড়াই করেই তাকে টিকে থাকতে হয়েছে। সব থেকে বড় কথা, পরবর্তী সময়ে যারা আমেরিকার নেতৃত্বের চেয়ারে বসেছেন, সবাইকে পড়তে হয়েছে তীব্র চাপ ও পরীক্ষার মুখে।

আরো খারাপ সংবাদ হলো, বুশের উত্তরসূরিদের অধীনে বিশ্ব কখনোই ভালো জায়গায় ছিল না। শান্ত ছিল না মধ্যপ্রাচ্যের মাটিও। কোনো এক বিশেষ কারণে এই অঞ্চলই হয়ে ওঠে সংঘাতের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যু ক্রমশ খারাপ হতে হতে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়, যা কেবল রক্তারক্তিই কারণ হয়ে ওঠে।

সত্যি বলতে, এই অঞ্চলে শান্তি ফেরাতে জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলোও আলোর মুখ দেখেনি সেভাবে। ন্যায়বিচার উপেক্ষিত থেকেছে সব সময়। একই বৃত্তে আটকে থেকেছে ইসরাইল-ফিলিস্তিন ‘দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান’। এই অর্থে বলতে হয়, মার্কিন নেতৃত্বাধীন বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা ফিলিস্তিন ট্র্যাজেডির ন্যায্য ও টেকসই তথা স্থায়ী সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘের প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক আইন, অসলো চুক্তি, দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান মুখ থুবড়ে পড়েছে সব প্রচেষ্টা, উদ্যোগ।

লক্ষ করলে দেখা যাবে, ইসরাইলে একটি করে নতুন সরকার এসেছে আর সব ধরনের আন্তর্জাতিক প্রস্তাবকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। সব ধরনের বন্দোবস্তকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে লাইনের বাইরে। কীভাবে ফিলিস্তিনিদের নায্য অধিকার খর্ব করা যায়, তা-ই বড় করে দেখেছে সরকারগুলো। বর্তমান ফার রাইট ইসরাইলি মন্ত্রিসভাও এর ব্যতিক্রম নয়।

আজ গাজায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, যেভাবে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, তা যে কোনো ট্র্যাজেডিকেই হার মানায়। বৈশ্বিক আধিপত্যবাদের কারণেই মূলত এমনটা ঘটছে। এর ফলে বিশ্বব্যবস্থা একেবারে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে—সচেতন ব্যক্তিমাত্রই এই সত্য অনুধাবন করতে পারেন। গাজার হাসপাতালগুলোতে বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণের মাধ্যমে আবালবৃদ্ধবণিতা, চিকিত্সক, সাংবাদিকসহ বেসামরিক নাগরিকদের যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে, তা স্পষ্টত যুদ্ধাপরাধের শামিল। বিশ্বব্যবস্থা কি এভাবে চলতে পারে?

প্রশ্ন হলো, প্রেসিডেন্ট বুশ সিনিয়র যে প্রতিশ্রুতির বাণী শুনিয়েছিলেন, তা কি পূরণ হয়েছে? অবশ্যই না। গাজার গণহত্যা সাক্ষ্য দেয়, বুশের কথা কানে তোলা হয়নি। অর্থাত্, যেসব প্রতিশ্রুতির কথা বলে সেই সময় নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল, তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, যা নিয়ে দ্বিমত থাকা উচত নয়। এই অবস্থায় বিকল্প কী হতে পারে? হ্যাঁ, আসলেই; ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা গড়ার প্রশ্নে বৈশ্বিক পরিবর্তন আনতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, গোটা বিশ্বের স্থিতিশীলতার স্বার্থেই এটা আজ অনেক বেশি জরুরি। কোনো সন্দেহ নেই, এর বিপরীত চিন্তা করলে তা বিশ্বের জন্য বয়ে আনবে ‘নতুন নতুন সংকট’।

লেখক: জর্ডানের সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

গালফ নিউজ থেকে অনুবাদ: সুমৃত খান সুজন

 

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন