শুক্রবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নিজের একটিমাত্র ভোটের মূল্য সুবিশাল

আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২৩, ০৬:৩০

গণতন্ত্র আসলে কী? এই ব্যাপারে সবচাইতে প্রচলিত সংজ্ঞা বলিয়াছেন যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। তিনি বলিয়াছেন, ডেমোক্রেসি ইজ এ গভর্মেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল অ্যান্ড ফর দ্য পিপল। এই ধরনের কথা ১৩৮৪ সালে জন উইক্লিফ বলিয়াছিলেন বাইবেল প্রসঙ্গে। সেইখানে তিনি বলিয়াছিলেন, দিজ বাইবেল ইজ ফর দ্য গভর্মেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল অ্যান্ড ফর দ্য পিপল।

গণতন্ত্রকে বলা হয় বিশ্বের সবচাইতে গ্রহণযোগ্য শাসনতন্ত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ সুম্পিটার ১৯৪৬ সালে তাহার ‘ক্যাপিটালিজম, সোশ্যালিজম অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ গ্রন্থে বলিয়াছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হইতেছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, যেইখানে জনগণের ভোট পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা লাভ করে। গণতন্ত্রের তিনটি উপাদানকে মৌলিক বা বুনিয়াদি বলিয়া বিবেচনা করা হয়, তাহার মধ্যে প্রথমটি হইল—সর্বজনীন ভোটাধিকার। ইহার পরে রহিয়াছে অবাধ, প্রতিযোগিতামূলক, বহুদলীয় নির্বাচন। এখন আমরা তৃতীয় বিশ্বের পাশাপাশি উন্নত বিশ্বেও দেখি ভোট লইয়া নানান ধরনের মেকানিজম করা হয়, মিথ্যাচার করা হয়। মিথ্যায় মিথ্যায় সয়লাব করা হয় জনগণের মনোজগত্। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যাহারা নির্বাচিত হইয়া আসেন, তাহাদের কার্যক্রম অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক হইতে হইবে; কিন্তু তাহা কতখানি ব্যত্যয় হইতেছে—ইহার দৃষ্টান্তের শেষ নাই। সার্বিকভাবে নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার ক্রমেই অবনতির কারণে মানুষ নির্বাচন ও গণতন্ত্র লইয়া সংশয়ের মধ্যে পড়িয়া যাইতেছে। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার একে অপরের পরিপূরক। নির্বাচনের মধ্য দিয়াই জনগণের স্বাধীন মত প্রকাশের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়; কিন্তু বাস্তবতা হইল—পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের মাটির যেমন সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রহিয়াছে, সকল মাটিতে সকল বৃক্ষ জন্মায় না। মেরু ভল্লুক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বাঁচিবে না। তেমনি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের কোনো প্রাণীই মেরু অঞ্চলে টিকিয়া থাকিতে পারিবে না।

গণতন্ত্র নিঃসন্দেহে বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে গ্রহণযোগ্য হিতকারী শাসনতন্ত্র। তবে এই হিতকারী বৃক্ষটি ভিনদেশ হইতে আমদানি করা হইয়াছে। সুতরাং উহার ফলন সকল মাটিতে ভালো নাও হইতে পারে। তাহা ছাড়া ইহার কিছু পরগাছা বা আগাছাও রহিয়াছে। সেই সকল পরগাছা নির্মূলে নিয়মিত পরিচর্যা প্রয়োজন; কিন্তু উন্নত বিশ্বে উহার চেষ্টা থাকিলেও তৃতীয় বিশ্বে খামতি রহিয়াছে। ইহা রাতারাতি দূর হইবারও নহে। তাহা ছাড়া বিরোধিতাই যে গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। মানুষে-মানুষে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে, স্বার্থে-স্বার্থে যে সংঘাত, রাজনৈতিক বিরোধিতার মাধ্যমে তাহার মোকাবিলাই গণতন্ত্রের পদ্ধতি। এইভাবেই গণতন্ত্র সকল গোষ্ঠী, মতকে স্থান দিতে পারে। গণতন্ত্র মানে যে শুধু ক্ষমতা নহে, তাহা উপলব্ধি করাটাও গণতন্ত্রের জন্য জরুরি বটে। এই জন্য আধুনিক সময়ে অনেক বিজ্ঞজনের মতে, গণতন্ত্র হইল স্টেট অব মাইন্ড। সেইখানে কথা বলিবার যেমন অবারিত স্বাধীনতা থাকিবে, মুক্তচিন্তার ফল্গুধারা বহিবে। ইহার সহিত সেইখানে বিপরীত বা ভিন্ন মতের অন্যকে সম্মান করিবার বিষয়টি থাকিতেই হইবে; কিন্তু গণতন্ত্রের এই মূলগত বৈশিষ্ট্য—তাহা আমরা উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশেই দেখিতে পাই না।

আরেকটি বড় বিষয় হইল, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাহার প্রতিনিধি তথা সরকার নির্বাচন করে, তৃতীয় বিশ্বের সিংহভাগ জনগণ বুঝিতেই পারেন না, কী অপার ক্ষমতার অধিকারী তাহারা। কে তাহাদের শাসন করিবে, তাহা নির্ধারণের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুরুভার তাহাদের স্কন্ধে অর্পিত রহিয়াছে; কিন্তু এই গুরুভার তাহারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুধাবন করিতে পারেন না। এই জন্য অনেকে গুরুত্বই দেন না তাহার ভোটাধিকারটি। তাহার ভোট কতখানি মূল্যবান—তাহা বুঝিতে পারেন না বিধায় অনেকে সামান্য অর্থের বিনিময়ে বিক্রয় হইয়া যান। সুতরাং গণতন্ত্রের জন্য আমাদের জনগণকেও উপযুক্ত হইয়া উঠিতে হইবে, নিজেদের ভোটের মূল্য বুঝিতে শিখিতে হইবে।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন