মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও রাজস্ব প্রাপ্তিতে অগ্রগতি নেই কেন?

আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২৩, ০২:০২

সরকার সুপ্রিম কোর্টের সিভিল আপিল নং-৪৮/২০১১-এর নির্দেশনা অনুযায়ী আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ রহিতক্রমে আয়কর আইন, ২০২৩ (২০২৩ সালের ১২ নং আইন) ২০ জুন, ২০২৩ তারিখে মহান জাতীয় সংসদে পাশ করেন। বাংলা ভাষায় প্রণীত এই আইন ১ জুলাই, ২০২৩ থেকে কার্যকর হয়েছে। পুরাতন অধ্যাদেশে নেই এরকম নতুন কিছু বিধানের চুম্বক অংশ নিম্নে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

 প্রত্যেক করদাতাকে কর দিবসের মধ্যে বা এর আগে রিটার্ন জমা করতে হবে। সময় প্রার্থনার সুযোগ নেই। (ধারা ১৭১)। কর দিবসের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে না পারলে কেউ কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত হবেন না। ধারা ৭৬(৫) (ক)। অতালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে শেয়ারের অভিহিত মূল্য ও ন্যায্যমূল্যের পার্থক্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর প্রদানের চালান যুক্ত না করলে হস্তান্তর নিবন্ধিত হবে না। ধারা ১৩৪। এক্ষেত্রে শেয়ার হস্তান্তরকে পূর্বে পেশাদার মূল্যায়নকারী কর্তৃক মূল্যায়ন রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। কর অব্যাহতিপ্রাপ্তির নিমিত্তে বিনিয়োগের ক্ষেত্রসমূহ ষষ্ঠ তপশিল অংশ-৩-এ বর্ণিত রয়েছে। এছাড়া করমুক্ত আয়:ব্যক্তি সাড়ে ৩ লাখ, নারী ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে পুরুষ সাড়ে ৪ লাখ, তৃতীয় লিঙ্গ ৪ লাখ ৭৫ হাজার, প্রতিবন্ধী ৪ লাখ ৭৫ হাজার, গেজেটেড যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ৫ লাখ ধনের ওপর কর বা সারচার্জ ৪ কোটি টাকা পর্যন্ত।

ভারতের কর জিডিপির অনুপাত ১২ শতাংশ, ভুটানের ১৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ১১.৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ১১ শতাংশ। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর গড় অনুপাত প্রায় ১৮ শতাংশ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কর জিডিপির অনুপাত ৩৫-৪০ শতাংশ। বিগত বছরগুলোতে বাজেট প্রণয়নের সময় কর জিডিপির অনুপাত ১০-১১ শতাংশ অনুমান করলেও কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় আমাদের দেশের এই অনুপাত নিম্নমুখী হয়েছে। আয়কর প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মানুষের অনীহা আগে যা ছিল, এখনো তেমন আছে। অনভ্যাস, অনিচ্ছা, শঙ্কা, আইন অমান্যের প্রবণতা, দেশপ্রেমের অভাব প্রভৃতি কারণে সামর্থ্য থাকলেও দেশের মানুষ কর প্রদান করতে চায় না। বছরে প্রচুর টাকা মানুষ বাজে খরচ কিংবা অপেক্ষাকৃত অল্প প্রয়োজনে খরচ করে। এর কিছু অংশ কর দিলেও নৈতিক দায়িত্ব পালন করা হয়। শুধু ব্যক্তিশ্রেণি নয়, ব্যবসায়ীদের মধ্যেও কর ফাঁকির প্রবণতা বিদ্যমান। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।

সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের দায়িত্ব মূলত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর ন্যন্ত। এই সংস্থার অধীন কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও কাস্টমস কমিশনারেটগুলো বার্ষিক বাজেটে এদের ওপর ন্যস্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে রাজস্ব আহরণে সচেষ্ট থাকে। বাজেট প্রণয়নের সময় এনবিআর প্রয়োজনে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে আইন পরিবর্তন বা সংশোধন এবং প্রশাসনিক আদেশ ও প্রজ্ঞাপন জারি করে সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণের চেষ্টা করে। এসব সংশোধন ও পরিবর্তনে কর হ্রাস-বৃদ্ধি ছাড়াও নীতিসহায়তা থাকে, যার ফলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে, ফলে স্বাভাবিকভাবে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ে। মূলত রাজস্ব প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা, আমদানি-রপ্তানি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকারি রাজস্ব ও প্রকল্প বরাদ্দের সুষ্ঠু ব্যয় এবং সর্বোপরি রাজস্ব সংগ্রহে নিয়োজিত কর্মচারীদের পেশাদারত্বের ওপর।

কর, ভ্যাট ও কাস্টমস ডিউটি রাজস্বের এই তিন শ্রেণিকে সাধারণত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিগত সরকারগুলো বার্ষিক বাজেট ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনয়নে চেষ্টা করে। সরকার, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও ভোক্তা জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে ক্রমান্বয়ে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ফলে উত্পাদন, কর্মসংস্থান ও ভোগ চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যা বছর শেষে জিডিপির আকার ও শতকরা প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। তাই দেখা যায়, ১৯৭২-৭৩ সালের ৮ বিলিয়ন ডলার জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে ৪০৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। বিগত প্রায় ৩০ বছর ধরে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে ৭-২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি থাকলেও দেশের কর জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারেনি, বরং বিগত দুই বছর কর জিডিপির অনুপাত ৮ শতাংশের কাছাকাছি থাকে। মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) অনুপাতে আমাদের করের পরিমাণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নিম্নতম। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের হিসাবমতে, দক্ষিণ এশিয়ায় নেপালের কর জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে বেশি—প্রায় ১৯ শতাংশ।

আমাদের দেশের ব্যক্তিশ্রেণির করদাতা জনসংখ্যার অনুপাত মাত্র ১ শতাংশের মতো। গত বেশ কয়েক বছর ধরে আয়কর মেলা এবং নানা বিজ্ঞাপনমূলক প্রচারণা সত্ত্বেও আয়কর রিটার্ন দাখিলকারীর সংখ্যা ২৪-২৫ লাখের ওপরে তোলা যায়নি। উেস কর, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদির কর বিবেচনায় প্রায় ১ কোটি লোক কোনো না কোনোভাবে কর দেয় বলে ধরা যায়। জমি ক্রয়, নানা ক্ষেত্রে আয়কর রেয়াত, ব্যাংক এবং অন্যবিধ সেবাদাতার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের মানুষ ই-টিআইএন নম্বর নিয়ে থাকে। বর্তমানে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ৬৭ লাখ। বাস্তবে এর ৩৫ শতাংশ মাত্র রিটার্ন জমা দেয়। আবার রিটার্ন জমাদানকারীদের একটা বড় অংশ ০ (শূন্য) কর দেয়। অনুরূপভাবে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর দেয় না। ব্যবসার আকার ও ধরনভেদে যেখানে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে কর দেয়। করের আওতা সম্প্রসারণ এনবিআরের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে করের হার কমানো হয়েছে ব্যক্তিশ্রেণি ও করপোরেট উভয় ক্ষেত্রে। দীর্ঘদিন ধরে করপোরেট করহার বেশি বলে আমাদের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন।

সেজন্য গত চার বছরে করপোরেট করহার সাড়ে ৭ শতাংশ কমানো হয়েছে। বর্তমানে এই হার ৩০ শতাংশ, তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে সাড়ে ২২ শতাংশ। নতুন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এই হার ২৫ শতাংশ। তবে সিগারেট ও তামাকজাত দ্রব্য এবং মোবাইল কোম্পানির করপোরেট করহার সবচেয়ে বেশি—৪৫ শতাংশ। সরকার এ দুই উত্স থেকে যেমন কর পায় বেশি, তেমনি এসব কোম্পানির কর প্রদানে মোটামুটি স্বচ্ছতা রয়েছে। আইন করেই লাভ কী, রাজস্ব আদায়ে যদি দুর্বলতা থাকে? বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশে কোটিপতির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৯২ হাজার। গত ১৪ বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ গুণ। অন্যদিকে আয়কর দেন মাত্র ২৯ লাখ। ২০১০ সালে গোটা বাংলাদেশে মোটরযানের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৭ লাখ। আর ২০২৩ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৮ লাখ। বাড়ি, গাড়ি আর রাতারাতি কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও সেই তুলনায় করদাতার সংখ্যা বাড়েনি। কারণ, রাজস্ব আদায়ে রয়েছে দুর্বলতা। বাড়ি-গাড়ি আর কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও রাজস্ব প্রাপ্তিতে কেন অগ্রগতি নেই, এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক—বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন