বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

যুদ্ধের অভিঘাত থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হবে

আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২৩, ০৬:৩০

গতকাল পালিত হয়েছে বিশ্ব শিশু দিবস। বিশ্বব্যাপী শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়কে মাথায় রেখে এই দিবসের পটভূমি রচিত হয় আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে। তবে প্রশ্ন হলো, কতটা নিশ্চিত হয়েছে শিশু অধিকার? প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ, বিশেষত হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে শিশুদের যেভাবে বলি হতে দেখা যাচ্ছে, তাতে করে এই জিজ্ঞাসা অবান্তর নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় প্রতি পাঁচ মিনিটে একটি করে শিশু নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। মৃত্যুপুরী গাজায় এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার শিশু নিহত হয়েছে ইসরাইলি বাহিনীর ছোড়া বোমার আঘাতে। কেবল গাজা নয়, আরো অনেক অঞ্চলে ঝরছে কোমলমতি শিশুর প্রাণ। বুলেট-বোমার আঘাতে চোখের নিমেষে ঝরে যাচ্ছে একেকটি ফুল—কী বীভত্স সেই দৃশ্য! 

আজকের বিশ্বে যে কেউই স্বীকার করবেন, ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগের সর্বোত্তম উপায় হলো সন্তানের পেছনে বিনিয়োগ করা। যারা এটা করেন, তারা বুদ্ধিমান-বিচক্ষণ নিঃসন্দেহে। এই অর্থে বলতে হয়, বিশ্বের নানা প্রান্তের সব শিশুর সার্বিক কল্যাণ ও সুষ্ঠু বিকাশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেক কিছু করার আছে। করাটা জরুরিও বটে।

আমরা দেখেছি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইগ্লান্টিন জেবের হাত ধরে গড়ে ওঠে শিশুকল্যাণ সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’। জেবের এই মহত্ উদ্যোগের জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট হবে না। শিশুসুরক্ষা ও উন্নয়নে তিনি মূলত এমন এক রূপরেখা (খসড়া নথি) অঙ্কন করেছিলেন, যা বিশ্বের সব শিশুর জন্য সর্বোচ্চ রক্ষাকবচ হিসেবে পরিগণিত। শিশুর অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতের ওপর ব্যাপকভাবে জোর দিয়েছিলেন তিনি। শিশু অগ্রাধিকারকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কর্তব্যের ওপরও গুরুত্বারোপ করেছিলেন।

১৯২৪ সালে লিগ অব নেশনসে জেবের খসড়া নথি গৃহীত হয়। শিশুদের নিরাপত্তা-সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এটা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কারণ, কোনো আন্তঃসরকারি সংস্থা কর্তৃক গৃহীত মানবাধিকার-সম্পর্কিত প্রথম দলিল এটাই, যা পরবর্তী সময়ে শিশু অধিকারের চূড়ান্ত ঘোষণায় পরিণত হয়। এই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সর্বজনীন শিশু দিবস হিসেবে বেছে নেয় ২০ নভেম্বরকে—তারিখটি ১৯৫৯ সালে শিশু অধিকারের ঘোষণাপত্রে চূড়ান্ত করা হয়। এভাবে অতিবাহিত হয় তিন দশক কাল। এরপর শিশু অধিকার দলিলের বর্ধিত সংস্করণ গৃহীত হয় জাতিসংঘে, যা আজ ‘শিশু অধিকার কনভেনশন (কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড)’ নামে সমধিক পরিচিত।

শিশু অধিকার কনভেনশন অত্যন্ত গুরুত্ববহ এ কারণে যে, বিশ্বের প্রত্যেক শিশুর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক অধিকার, এমনকি মানবাধিকার পর্যন্ত সমুন্নত রাখার কথা বলা আছে এই কনভেনশনে। শিশুদের অধিকারের মধ্যে রয়েছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও বিশুদ্ধ পানির মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের নিশ্চয়তা। যে কোনো ধরনের অত্যাচার, শোষণ কিংবা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি থেকে সুরক্ষার বিষয়ও শিশু অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। শিশুর মতামত প্রকাশের সুযোগও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মোটা দাগে।

উল্লেখ করার বিষয়, শিশু অধিকার কনভেনশনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ রয়েছে। এক. যে কোনো ধরনের বৈষম্য থেকে শিশুদের সুরক্ষা। দুই. শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। তিন. শিশুদের জীবনমানের উন্নয়নের পাশাপাশি তাদের বিকাশ ও বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা।

আজকের দিনে দেখার বিষয়, শিশু অধিকার কনভেনশনে যেভাবে উল্লেখ আছে, সে অনুযায়ী শিশুর অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে কি না। শিশুসুরক্ষার খসড়া নথি লিগ অব নেশনস কর্তৃক গৃহীত হওয়ার ১০০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, শিশুদের সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বিশেষ করে, যুদ্ধের সময় শিশুদের যেভাবে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে যেতে দেখা যায়, তাতে করে শিশুসুরক্ষার বিষয়কে যাচ্ছেতাইভাবে দেখা হয়েছে এবং হচ্ছে বলে প্রতীয়মান।

ওপরের দাবির সঙ্গে একমত খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তার কথা অনুযায়ী, হামাস-ইসরাইল সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনের গাজা হয়ে উঠেছে ‘শিশুদের কবরস্থান’। বাস্তবতা হলো, যুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় শিশুরাই।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনের দিকে তাকানো যাক। গাজায় এবারের সহিংসতা শুরু হওয়ার আগে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের শিশুদের ওপর এক জরিপ চালায় সংস্থাটি। ‘ওয়েস্ট ব্যাংক :স্পাইক ইন ইসরাইলি কিলিং অব প্যালেস্টাইনিয়ান চিলড্রেন’ শিরোনামে প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ঐ প্রতিবেদনে উঠে আসে, গত বছর তথা ২০২২ সালে পশ্চিম তীরে শিশুদের অবস্থা এতটা শোচনীয় হয়ে ওঠে, যা বিগত ১৫ বছরের মধ্যে রেকর্ড। প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়, ২০২৩ সালে অবস্থা আরো খারাপ হবে। সত্যি বলতে, পশ্চিম তীরের শিশুদের দুর্দশার অবস্থা কেবল খারাপের দিকেই গেছে এই বছর। তার চেয়ে বড় দুঃসংবাদ, পশ্চিম তীরের চেয়ে গাজার শিশুদের গল্প আরো করুণ। হাজার হাজার শিশু বেঘোরে মারা পড়ছে, সুরক্ষা তো বহু দূরের বিষয়।

পরিতাপের বিষয় হলো, ইসরাইলি সেনাদের নির্বিচার বোমা বর্ষণের কারণে গাজায় কোমলমতি শিশুদের প্রাণ ঝরে গেলেও তা বন্ধে জাতিসংঘ কিংবা কোনো পক্ষকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। শিশুদের সুরক্ষার প্রশ্নে সবাই যেন অক্ষম হয়ে পড়েছে। কোনোভাবে যদি ‘যুদ্ধবিরতি’ করা যেত, তাহলে বেঁচে যেত ছোট্ট শিশুদের প্রাণ। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই কাজটি করতে পারে অনায়াসে, কিন্তু তা ‘এক বিশেষ খেলার ছকে’ আটকে পড়ে আছে!

জাতিসংঘের প্রায় ১০০ সদস্য রাষ্ট্র হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে আসছে। এর পরও জাতিসংঘের যেন করার কিছুই নেই! সংস্থাটি পঙ্গু হয়ে গেছে—এ ধরনের কথা বললে কি বাড়িয়ে বলা হবে?

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বহুবার হতাশা প্রকাশ করেছেন। শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিতে জাতিসংঘ কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে সব সময়ই সংক্ষুব্ধ হতে দেখা যাচ্ছে। স্বয়ং মহাসচিবের এ ধরনের অনুভূতি দেখে পরিষ্কার বোঝা যায়, জাতিসংঘের কাঠামোতে সংস্কার আনা অতি জরুরি। এই বিশ্বসংস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে করে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা যেন কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করার সুযোগ না ঘটে; কেবল কোনো একটি সদস্য-রাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনচ্ছাির পুতুলে পরিণত না হয় এই বিশ্ব সংস্থা।

যুদ্ধবিরতি সম্ভব না হলেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (ইউএনএসসি) অতি সম্প্রতি একটি প্রস্তাব পাশ করেছে, যা গাজার শিশুদের জন্য স্বস্তি বয়ে আনতে পারে। গাজায় শিশুদের ওপর অমানবিকতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ইউএনএসসি বলেছে, ‘সব পক্ষকে আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হবে। বেসামরিক নাগরিক এবং বিশেষ করে শিশুদের সুরক্ষার বিষয় যেন কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়।’ একে ‘সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ’ বলতে হয়।

শুধু গাজা নয়, বিশ্বের আরো বেশ কিছু অঞ্চলে ‘ভালো নেই শিশুরা’। চলমান যুদ্ধবিগ্রহের কারণে বিগত সাত মাস ধরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার সুদানের শিশুরা। সহিংসতা, অপব্যবহার ও শোষণের শিকার হচ্ছে দেশটির লাখ লাখ শিশু। দেশের ৯টি ক্যাম্পে পাঁচ বছরের কম বয়সি ১ হাজারেরও বেশি শিশু মারা গেছে এরই মধ্যে। আরেক মহা ট্র্যাজেডি হলো সৈনিক হিসেবে সুদানে শিশুদের বাধ্যতামূলক নিয়োগ। যুদ্ধকবলিত অঞ্চলে শিশুদের জোরপূর্বক যুদ্ধের কাজে ব্যবহারের এই প্রবণতা বন্ধ করতে না পারলে ‘বৈশ্বিক শিশু সুরক্ষা’ একেবারে ভেঙে পড়বে। তাছাড়া এটা গুরুতর অপরাধ। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

সংঘাত ও অস্থিতিশীল সময়ে অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠী শিশুদের যুদ্ধের কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কখনো কখনো শিশুদের অপহরণ করে এই কাজে লাগানো হয়। আর্থিক প্রণোদনাও তথা অর্থের লোভ দেখিয়ে শিশুদের যুদ্ধের কাজে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত আমাদের অজানা নয়। শিশুর দারিদ্র্যকে এভাবে কাজে লাগানোর প্রবণতা অতি নিকৃষ্ট মানসিকতার পরিচায়ক।

এই যখন অবস্থা, তখন শিশুদের সুরক্ষার পাশাপাশি তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেখা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবশ্য কর্তব্য। আমরা যদি ভবিষ্যতে কোনো ভালো বিনিয়োগ করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই সন্তানের পেছনে বিনিয়োগ করা শুরু করতে হবে। নিঃসন্দেহে এর চেয়ে ভালো বিনিয়োগ আর কিছুই হতে পারে না।

লেখক: ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী

আরব নিউজ থেকে অনুবাদ: সুমৃত খান সুজন

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন