করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্বে জ্বালানিসংকট দেখা দেয়। এই সংকট এখনো কাটে নাই। জ্বালানিনিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার উপর অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহুলাংশে নির্ভরশীল। এই কথা মাথায় রাখিয়া চলতি বত্সর ১৮ মার্চ ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অনলাইনে যুক্ত হইয়া এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তৈল সরবরাহ কার্যক্রমের শুভসূচনা করেন। ইহার ফলে জ্বালানি তৈলের বাজারে অনেকটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়া আসিয়াছে; কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের পাইপলাইন হইতে তৈল চুরির ঘটনায় দেখা দিয়াছে উদ্বেগ।
খবরে প্রকাশ, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায় বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন ছিদ্র করিয়া তৈল চুরির বিষয়টি জানাজানি হয় গত ২৪ নভেম্বর। পার্বতীপুর রিসিপ্ট টার্মিনালের কন্ট্রোল রুম অ্যাটেনডেন্টকে ইহা অবহিত করে ভারতের শিলিগুড়ি মার্কেটিং টার্মিনাল। দুঃখজনক হইল—এই তৈল চুরির বিষয়টি আমরা প্রথমে ধরিতে পারি নাই। ইহা আমাদের চরম ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নহে। ভারতের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চিরিরবন্দর থানার ৩ নম্বর ফতেজংপুর ইউনিয়নের ফেরুসাডাঙ্গা হইতে কুতপাড়া গ্রামের শাষকান্দর কাঁচা রাস্তার উত্তর পার্শ্বে অধিগ্রহণকৃত জমিতে গিয়া পাওয়া যায় ডিজেলের গন্ধ। ইহার সহিত সেইখানকার মাটি আলগা অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায়। অতঃপর ফায়ার সার্ভিস সেইখানকার মাটি খুঁড়িয়া দেখিতে পায় যে, পাইপলাইন ছিদ্র করিয়া ক্লাম্পের উপরে ওয়েল্ডিংকৃত এক ইঞ্চি পাইপসহ বলভাল্ব সংযুক্ত করিয়া তৈরি করা হইয়াছে বিকল্প লাইন। এই জন্য পাইপলাইনের নিকট ছয় ফুট গর্ত করা হইয়াছে। মূল পাইপ ফুটা করিয়া তাহাতে স্ক্রু লাগাইয়া একটি পৃথক চিকন পাইপলাইনের মাধ্যমে এই তৈল চুরির ঘটনা ঘটিতেছিল। এই ঘটনায় যে বা যাহারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাহাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হইয়া পড়িয়াছে। ইতিমধ্যে চার জনকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। দেশের স্বার্থেই এই ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
উল্লেখ্য, ভারতের নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেডের শিলিগুড়ির মার্কেটিং রেল টার্মিনাল হইতে বাংলাদেশের দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত স্থাপন করা হইয়াছে ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত-বাংলাদেশ পাইপলাইন প্রকল্প। ইহার মধ্যে বাংলাদেশ অংশে ১২৬ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার এবং ভারতীয় অংশে পাঁচ কিলোমিটার পড়িয়াছে। এই পাইপলাইনের নিরাপত্তার বিষয়টি কেন গুরুত্ব দেওয়া হইবে না? বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বা বিপিসি সূত্রে জানা যায়, এই প্রকল্পের পাইপলাইনগুলি দেখভাল করিবার জন্য আলাদা একটি কোম্পানি গঠন করা হইয়াছে; কিন্তু সেই কোম্পানির কার্যক্রম এখনো পুরাদমে শুরু হয় নাই। এই কোম্পানির কার্যক্রম কীভাবে সম্পূর্ণরূপে শুরু করা যায়, সেই ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ লওয়া হয় নাই কেন, বোধগম্য নহে।
আমাদের জানা মতে, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মিটাইতে উপরিউক্ত প্রকল্পের ন্যায় আরো কয়েকটি প্রকল্পের আওতায় একাধিক তৈলের পাইপলাইন নির্মাণাধীন রহিয়াছে। ইহার অন্যতম হইল ঢাকা-চট্টগ্রাম তৈল পাইপলাইন, পিতলগঞ্জ কাঞ্চন-এয়ারপোর্ট তৈল পাইপলাইন ও গোদনাইল-ফতুল্লা তৈল পাইপলাইন। মাইলের পর মাইল কৃষিজমির মধ্য দিয়া আসিতেছে এই সকল পাইপলাইন। তাই স্বভাবতই তৈল চুরির ঝুঁকি থাকিয়া যায়। এই জন্য এখন হইতেই এই ব্যাপারে আমাদের আরো সতর্ক হইতে হইবে। এই সকল পাইপলাইন উদ্বোধনের দিন হইতেই যাহাতে সকল প্রকার নিরাপত্তার বিধান করা হয়, সেদিকে নজর দিতে হইবে। যেই হেতু ইহার সহিত আমাদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির বিষয়টিও জড়িত, তাই অবিলম্বে এই চৌর্যবৃত্তি বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে।