মানুষের জীবনে মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে প্রথম প্রয়োজনীয় চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। অন্য সব উপাদানের সঙ্গে আপস করা গেলেও খাদ্য ছাড়া বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব। হিসাব করে দেখা গেছে, মাথাপিছু ক্যালরির প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মাটি থেকে আসে। এ কারণে মাটির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আর খাদ্যশস্য উত্পাদনের জন্য মাটির সঙ্গে পানির সম্পর্ক অবশ্যম্ভাবী। মাটিতে উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় যতই পুষ্টি উপাদান থাকুক না কেন, পানি ছাড়া তা গাছের কোনো কাজে আসে না। তুলনামূলকভাবে পানি ও জৈব পদার্থ কম থাকায় মরুভূমির মাটিকে মৃত ধরা হয়। মাটির সঙ্গে পানির আন্তঃক্রিয়ার ফলে উদ্ভিদ জন্মে এবং জীবের জন্য খাদ্য তৈরি হয়। কিন্তু আজ মৃত্তিকা ও পানি সম্পদ নানা কারণে হুমকির সম্মুখীন।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ অর্থাত্ প্রায় ১১ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, এ মাটির পরিবেশ ও মাটির উর্বরতা আজ নানা কারণে হুমকির মুখে। মাটির অবক্ষয়ের কারণে আগামী ২৫ বছরে খাদ্যের দাম ৩০ শতাংশ বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মোট কৃষিজমির শতকরা ৭৫ ভাগ জমি উর্বরতা হারিয়েছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য খাদ্যচাহিদা দিনদিন বেড়ে চলেছে। প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭ শতাংশ (বিবিএস-২০১৯)। অন্যদিকে আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ সীমিত হচ্ছে। এক ফসলি জমিতে বছরে একটি, দুটি, তিনটি এমনকি চারটি ফসল চাষ করা হচ্ছে। ফলে মাটিতে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় ১৪টি পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে।
বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলসহ বরেন্দ্র ও মধুপুর গড় অঞ্চলের অধিকাংশ মাটি অত্যধিক থেকে অধিক অম্ল। প্রায় ২ লাখ ৭৮ হাজার হেক্টর জমির মাটি অত্যধিক অম্ল (পিএইচ মান ৪.৫ এর নিচে) এবং প্রায় ৩৬ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমির মাটি অধিক অম্ল (পিএইচ মান ৪.৫ থেকে ৫.৫)। ফলে এই সব অঞ্চলে আবাদকৃত ফসলের কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কাঙ্ক্ষিত ফলন পেতে হলে চুন প্রয়োগ করে এ ধরনের মাটির অত্যধিক ও অধিক অম্লতা হ্রাস করা আবশ্যক।
দেশের উপকূলবর্তী প্রায় ৫৩ শতাংশ অঞ্চল লবণাক্ততা দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত। বর্তমানে উপকূলবর্তী অঞ্চল ছাড়িয়ে লবণাক্ততা আক্রান্ত অঞ্চল ক্রমে বেড়ে চলেছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ২০০৯ সালের লবণাক্ততা জরিপের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ১.০৫৬ মিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত। মাটির লবণাক্ততা ফসলের স্বাভাবিক উত্পাদনে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে মাটির উত্পাদনশীলতা কমে যায় অনেকাংশে। অন্যদিকে দেশের এক-দশমাংশ পাহাড়ি এলাকা, বিশেষ করে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার পাহাড়ি মাটি দিন দিন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। যেখানে উপজাতীয় জনগণ জুমচাষ করে থাকেন। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ও সচেতনতার অভাবে জুমচাষের ফলে ব্যাপক আকারে মাটির অবক্ষয় হয়। জুমের আশপাশের নালা ও ছড়াগুলিতে পাহাড় থেকে নেমে আসা মাটি জমা হয়ে ভরাট হচ্ছে। অথচ একটু সচেতন হলে পাহাড়ি মৃত্তিকা ক্ষয়রোধ করে উর্বরতা বাড়ানো যায়।
এছাড়া নানা রকম বিষাক্ত পদার্থের কারণে দূষিত হয়ে পড়ছে দেশের উর্বর মাটি। গৃহস্থালির বর্জ্য, পলিথিন, কলকারখানার কঠিন ও তরল বর্জ্য মাটি দূষণের একটি বড় উত্স। কলকারখানা থেকে প্রচুর ভারী ধাতু যেমন আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, সিসা, নিকেল ইত্যাদি নদীনালা ও জমিতে মিশে মাটি দূষিত হয়। এছাড়া বছরের পর বছর একনাগাড়ে ভূমি কর্ষণ, প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহারও মাটি দূষণের জন্য দায়ী। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং ব্যাপক হারে বনভূমি ধ্বংস ও নদী ভাঙনের কারণে অনেক অঞ্চলের মাটি নষ্ট হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করতে এবং ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিয়মিত মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সুষম সারব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদার করা দরকার। প্রতি বছর হেক্টর প্রতি ১০ টন থেকে ১৫ টন জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। গবেষণায় জানা যায়, এক টন জৈবসার থেকে ১২০ ডলার থেকে ১৫০ ডলার মূল্যমানের রাসয়নিক সারের সাশ্রয় করা সম্ভব হয়। এর পাশাপাশি ভূমিক্ষয় রোধের সম্ভাব্য ব্যবস্থা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। মাটিতে জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা থাকলে পানি নিষ্কাশন করতে হবে। অধিক লবণযুক্ত মাটিতে লবণমুক্ত পানি দ্বারা সেচ প্রদান করতে হবে। সুপেয় ও চাষের জন্য পানির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যথাসম্ভব কমাতে হবে।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সারা বিশ্বব্যাপী আগামীকাল ৫ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস, ২০২৩’ পালন করা হচ্ছে। এ বছরের বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘Soil and Water: a source of life’ যার বাংলা ভাবার্থ—মাটি ও পানি :জীবনের উত্স। মাটি ও পানির গুরুত্ব সর্বমহলে অনুধাবনের জন্য এ বছরের প্রতিপাদ্যটি যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী হয়েছে বলে মনে করি।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক গবেষণাগার, ফরিদপুর