বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৬ ফাল্গুন ১৪৩১
The Daily Ittefaq

‘আইএমএফ’-এর সুপারিশকৃত সংস্কার

আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:৩০

যে কোনো সংস্কারের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার, এমনকি দেশের জনগণও অত্যন্ত রক্ষণশীল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক (ডব্লিউবি) প্রদত্ত সংস্কার প্রস্তাব অনিচ্ছা সত্ত্বেও গ্রহণ করেছি আমরা। চলতি মাসে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অনুমোদন পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ বেশ চাপের মধ্যে ছিল। ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের মধ্যে ৬৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ২য় কিস্তির অনুমোদনের আগে বাংলাদেশ সরকার আইএমএফের ঋণের জন্য বিশাল সংস্কারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার নাম ‘মেমোরেন্ডাম অব ইকোনমিক অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল পলিসিজ’ (এমইএফপি)। মুদ্রাবাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং রাজস্ব উত্পাদন বাড়াতে আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য নতুন শর্ত দিয়েছে। বাংলাদেশের নতুন লক্ষ্য কর, ঋণ, মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। আগামী বছরের মে মাসে ৪২ মাসের প্রোগ্রাম পর্যালোচনার সময় নতুন শর্তের অধীনে বাংলাদেশের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হবে, যখন বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে তৃতীয় কিস্তি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সরকার আগামী চার থেকে ছয় বছরের মধ্যে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য একটা পরিকল্পিত কাঠামো গঠনের জন্য একটা মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল (এমএলটিআরএস) প্রণয়ন করার পরিকল্পনা করেছে। এমইএফপি কিছু স্টেকহোল্ডারকে পরামর্শের পরিকল্পনা করেছে যেটা ২০২৪ সালের প্রথম দিকে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং আগামী বছরের জুনের মধ্যে কৌশলটি চূড়ান্ত করা হবে। আইএমএফ উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের উচ্চ মূল্য এবং স্থানীয় বাজারে তাদের সমন্বয়ের পাশাপাশি অপর্যাপ্ত নীতিব্যবস্থার কারণে মূল্যস্ফীতি এত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ভোক্তা মূল্যসূচক ৯.৪২ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে এটা ছিল ৯.০২ শতাংশ।

সীমিত রেমিট্যান্স ও রপ্তানি মূল্যের বিপরীতে উচ্চ আমদানি বিলের কারণে ‘গ্রোস ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ’ (জিআইআর) ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২৪.৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকার তিন বছরে ৫০টিরও বেশি সংস্কার কার্যক্রাম নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আইএমএফের প্রোগ্রামের অধীনে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি উন্নীত করার জন্য কাঠামোগত সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করতে সরকার সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কর, ঋণ, মুদ্রা এবং বিনিময় হার নীতি সম্পর্কিত সংস্কার। দৃঢ় মুদ্রানীতি এবং একটা নিরপেক্ষ আর্থিক অবস্থানের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ২০২৪ অর্থবছরে ৭.২৫ শতাংশের কাছাকাছি নামিয়ে আনা সম্ভব। নতুন শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যান্য সব ব্যাংককে স্থায়ী ঋণ এবং আমানত সুবিধার অ্যাক্সেসের অনুমতি দেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ওপেন মার্কেট অপারেশন (ওএমও) স্ট্রিমলাইন করবে এবং তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় বিধান ও রক্ষণাবেক্ষণের সময়কাল নির্ধারণ করবে। মার্চের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা প্রস্তুত করবে, যেখানে বিভিন্ন ঝুঁকির মূল্যায়নের মাপকাঠি সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য দেওয়া থাকবে। এছাড়াও, অর্থ মন্ত্রণালয় বাস্তবসম্মত ফিন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২০ সংসদে জমা দেবে। বাংলাদেশ সরকার বিনিময় হার এবং ব্যাংক ঋণের সুদের হার আরো নমনীয় করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে নির্ধারিত রেট পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হবে কি না, এ ব্যাপারে এমইএফপি কোনো সুস্পষ্ট বিধিমালা প্রকাশ করেনি।

এই পরিকল্পনার মধ্যে ট্যাক্স ও ভর্তুকিব্যবস্থার সমন্বয় সাধনও অন্তর্ভুক্ত, যা ২০২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা ছিল। এটা ২০২১ অর্থবছরের ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা থেকে ৪১ শতাংশের বেশি, যা মোট দেশজ উত্পাদনের প্রায় ৩.৫৬ শতাংশ। কর ব্যয় বলতে করের হার হ্রাস করা এবং মোট করযোগ্য আয়ের পরিমাণ থেকে আয় বাদ দেওয়াকে বোঝায়। এই লক্ষ্য অনুযায়ী, অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী অর্থবছরের বাজেটের অংশ হিসেবে ব্যক্তিগত আয়কর, করপোরেট আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর হিসাবে পরিচিত কর ব্যয় সম্পর্কে রিপোর্ট করবে। এনবিআর ভ্যাট এবং আয়করের পাশাপাশি একটা ‘ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান’ গ্রহণ করবে। পরিকল্পিত সংস্কার কার্যক্রমের অধীনে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও অন্যান্য নতুন শর্তের মূল্যায়ন করা হবে ২০২৪ সালের মে মাসে ৪২ মাসের কর্মসূচি পর্যালোচনার সময়, যখন বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকার করপোরেট কর, ব্যক্তিগত আয়কর, এবং মূল্য সংযোজন করের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর ভর্তুকি, যা কর ব্যয় হিসাবে পরিচিত, বিশ্লেষণ করার প্রস্তাব করেছে এবং ২০২৫ অর্থবছরের বাজেটের অংশ হিসেবে অ্যানালাইসিস রিপোর্ট প্রকাশ করবে। সরকার সব রকমের পেট্রোলিয়াম পণ্যের জন্য কাঠামোগত ভর্তুকি বাদ দেওয়ার পাশাপাশি একটা পর্যায়ক্রমিক সূত্রভিত্তিক মূল্য সমন্বয় পদ্ধতিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো বিদ্যুতের দাম সামঞ্জস্য করা এবং চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ অন্তর্ভুক্ত না করা, যেন বিদ্যুত্ উত্পাদনকারীদের যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেটা আরো কমানো সম্ভব হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে অবশিষ্ট কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় সরকার মূল্যস্ফীতিকে ৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার এবং ‘গ্রোস ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ’ (জিআইআর) প্রায় চার মাসে সম্ভাব্য আমদানি বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা করছে।

ঋণ নেওয়ার খরচ কমানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, সরকার জাতীয় সঞ্চয়পত্রের (এনএসসি) ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেবে এবং মধ্যমেয়াদে বাহ্যিক অর্থায়নের রেয়াতি উত্সকে প্রাধ্যান্য দেবে। এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে মূলত দেশীয় বাজারে বন্ডের চাহিদা বাড়ানোর জন্য, যা আমাদের ক্রমান্বয়ে দীর্ঘমেয়াদি বাজারের বিকাশে সহায়তা করবে। সরকার ইতিমধ্যেই একটা আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা তৈরি করেছে, কীভাবে এনএসসি ইস্যুকে ২০২৬ অর্থবছরের মধ্যে নেট ডোমেস্টিক ফিন্যান্সিংয়ের এক-চতুর্থাংশের নিচে রাখা যায়। সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের (এসওই) স্বচ্ছতা বাড়াতে কাজ করছে। তারা ইতিমধ্যেই একটা অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে ১২০টিরও বেশি এসওই-এর সাম্প্রতিক আর্থিক তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং তাদের আর্থিক ব্যবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করছে।

বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী এবং গ্রাহকের স্ট্যাটিসটিক্যাল ডেটা সম্পর্কে অনেক অভিযোগ রয়েছে। এমইএফপির আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত তথ্যের পরিসংখ্যান সমন্বয় করার একটা বিধান রয়েছে। এটা ২০২৪ সালের মার্চের মধ্যে একটা সাকুলার জারি করবে, যেখানে পরিসংখ্যানগত তথ্যগুলো ৯০ দিনের মধ্যে সমন্বয় না করলে সেটা বাতিল ঘোষণা করা হবে। এমইএফপি আর্থিক খাতকে নিয়মিত করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রচালিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিটের দুর্বলতা কমাতে সরকার এসসিবিগুলোর জন্য গড় এনপিএলের অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে রাখতে একটা নির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার ২০২৬ সালের মধ্যে এনপিএল ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার জন্য বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর (পিসিবি) জন্যও রোডম্যাপ তৈরি করেছে। এই রোডম্যাপগুলো মূলধনের পর্যাপ্ততা অনুপাত এবং এসসিবিগুলোর প্রভিশন কভারেজকে ১০ শতাংশ এবং প্রয়োজনীয় বিধানকে ১০০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করবে। পিসিবি ২০২৬ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ এবং ১০০ শতাংশে উন্নীত হবে। এনইএফপি নিশ্চিত করেছে যে, আইএমএফের সংস্কার কর্মসূচির লক্ষ্য অর্জনের জন্য অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে পিছপা হবে না এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিশ্রুত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে।

লেখক : বাংলাদেশ কমপিটিশন কমিশনের বেসরকারি উপদেষ্টা

ইংরেজি থেকে অনুবাদ :আব্দুল্লাহ আল মামুন

ইত্তেফাক/এএইচপি