র্যাপিড পাশ হইল স্মার্ট কার্ডভিত্তিক একটি ভাড়া সংগ্রহব্যবস্থা, যাহার মাধ্যমে গণপরিবহনের ভাড়া দ্রুতগতিতে পরিশোধ সম্ভব। ইহা মূলত ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মতো। যাত্রী কোনো গণপরিবহনে উঠার সময় কার্ডটি সেই যানবাহনে রাখা বিশেষ মেশিনে স্পর্শ করিবার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলিয়া উঠে সবুজ বাতি। আবার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থলে নামিয়া যাইবার পর অনুরূপ মেশিনে স্পর্শ করিলে তত্ক্ষণাত্ নির্ধারিত ভাড়া কাটিয়া রাখা হয়। উন্নত দেশগুলিতে এই পদ্ধতির প্রচলন থাকিবার কারণে ভাড়া লইয়া কোনো তর্কবিতর্ক যেমন হয় না, তেমনি যাত্রী হয়রানি কিংবা অযথা সময়ক্ষেপণের কোনো অবকাশ নাই। সম্প্রতি বাংলাদেশে মেট্রোরেল চালু হইবার পর আমরা এই ধরনের সেবা সম্পর্কে সম্যক অবগত হইতে এবং ইহার সুফল পাইতে শুরু করিয়াছি।
বর্তমানে রাজধানী ঢাকার মেট্রোরেলে বহুল ব্যবহূত পাশটির নাম এমআরটি (ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট) পাশ। তাহা হইলে প্রশ্ন হইল, র্যাপিড পাশ কী? প্রকৃতপক্ষে এমআরটি ও র্যাপিড পাশের কার্যকারিতা একই। শুধু কর্তৃপক্ষ আলাদা। এমআরটি পাশ প্রদান করিয়া থাকে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। আর র্যাপিড পাশের প্রবর্তক সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। এই ব্যাপারে কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করিতেছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি বা জাইকা। র্যাপিড পাশ হইল জাপানের সনি কোম্পানির তৈরি একটি নেয়ার-ফিল্ড কমিউনিকেশন (এনএফসি) স্মার্ট কার্ড। ইহাতে ইনটেগ্রেটেড সার্কিট সংযুক্ত এবং উপযুক্ত রিডারের সহিত সর্বোচ্চ ১০ সেন্টিমিটার দূরত্ব হইতে মাত্র শূন্য দশমিক ১ সেকেন্ডের মধ্যে এই কার্ড হইতে ডাটা আদান-প্রদান সম্ভব। ইহার নিরাপত্তাব্যবস্থা আইএসও কর্তৃক প্রত্যয়নকৃত।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশে এই র্যাপিড পাশ পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় ২০১৭ সালে এবং ২০১৮ সালে ইহার পূর্ণ বাস্তবায়ন শুরু হয়। অন্যান্য রেলওয়ে স্টেশন, বাস স্টপেজ ও টার্মিনাল এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পরিবহনব্যবস্থায় ইহা সংযুক্ত হইবার কথা ছিল; কিন্তু দুঃখজনক হইল, বিআরটিসির এসি বাস ও গুলশানের বিশেষ সার্কুলার বাস সার্ভিস ‘ঢাকা চাকা’ ছাড়া এই সিস্টেমের তেমন প্রচলন হয় নাই; কিন্তু মেট্রোরেলে এমআরটি’র সফল প্রয়োগের পর এখন নূতন করিয়া আলোচনায় চলিয়া আসিয়াছে এই ধরনের কার্ডের প্রয়োজনীয়তার কথা। যেহেতু র্যাপিড পাশ মেট্রোরেলেও ব্যবহার করা যাইতেছে, তাই বর্তমানে এমআরটি ও র্যাপিড পাশ উভয়েরই গ্রাহকসংখ্যা বাড়িয়া চলিয়াছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে এই প্রক্রিয়াকে আমরা সাধুবাদ না জানাইয়া পারি না।
এখন রেলওয়ে, লঞ্চ, সিটিং সার্ভিস বাসসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গণপরিবহনে এই প্রযুক্তির ব্যবহার সহজলভ্য হইয়া উঠিলে আমাদের দেশে গণপরিবহনে দীর্ঘদিন ধরিয়া যে ভাড়ার নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানির অভিযোগ রহিয়াছে, তাহার সমাধান হইয়া যাইবে। ইহাতে ভাড়া ফাঁকি দেওয়ারও সুযোগ নাই। এই জন্য ইহা লইয়া বেসরকারি পরিবহন মালিকদের সহিত পূর্বে আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। তাহারা এই প্রযুক্তির বিরোধিতা করেন এমনটি নহে। তবে এই জন্য প্রতিটি যানবাহনে যে ডিভাইস বা মেশিন স্থাপন করিতে হইবে এবং এই জন্য ব্যবস্থাপনাগত যে খরচ বৃদ্ধি পাইবে, তাহার ব্যাপারে সরকারের সহায়তা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। ইহার পাশাপাশি লেনদেনের প্রক্রিয়াটি একটিমাত্র ব্যাংকের হাতে রাখাটা অনুচিত। অন্যান্য ব্যাংক, সরকারি পেমেন্ট গেটওয়ে এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্টার-অপারেবল প্রযুক্তি ‘বিনিময়’ ও ‘এনপিএসবি’র মাধ্যমে র্যাপিড পাশের লেনদেনের সুযোগ উন্মুক্ত ও অবারিত রাখিলে ইহা সুবিধাজনক ও অধিকতর জনপ্রিয়তা লাভ করিবে।
বিআরটিসির ননএসি বাস, রেলওয়ে ও বিআইডব্লিউটিসির লঞ্চে র্যাপিড পাশের প্রচলনে সরকারের আন্তরিক চাওয়া ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলির মধ্যে সমন্বয়ই যথেষ্ট। তবে বেসরকারি বাস মালিকদের এই ব্যাপারে রাজি করাইতে বেগ পাইতে হইবে। এই সকল বাস মালিক নিজস্ব বিনিয়োগে যন্ত্র বসাইবার পর ডিটিসিএ তাহা র্যাপিড পাশের সফটওয়্যারের সহিত সংযুক্ত করিবে। ডিটিসিএ চায় ইহা বাধ্যতামূলক হউক। তবে বাধ্যতামূলক করিতে হইলে আইনি কাঠামো ছাড়া সম্ভব হইবে না। সর্বোপরি এক লক্ষ টাকার অধিক বিনিয়োগ করিতে মালিকেরা তেমন একটা উত্সাহিত হইবেন না বিধায় তাহাদের খরচ কীভাবে কমাইয়া আনা যায়, তাহা লইয়াও ভাবিতে হইবে। সমগ্র দেশের যোগাযোগ অবকাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আসিয়াছে। আমরা আশা করি, সামাজিক রূপান্তরের লক্ষ্যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারেও আমরা উন্নতি লাভ করিব।