শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
The Daily Ittefaq

বড়লোক হওয়া না হওয়া

আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৫:৩০

কিছু মানুষ আছে, যারা সারাক্ষণ কেবল হা-হুতাশ করে। তাদের কাছে দুনিয়ায় সমস্যা ছাড়া কিছু নেই। গণতন্ত্র, সুশাসন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, বিশ্বপরিস্থিতি, বেকার সমস্যা, মূল্যস্ফীতি, ডলারের সংকট, রিজার্ভের সংকট, লুটপাট, অর্থ পাচার ইত্যাদি নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আবার কিছু মানুষ আছে, যারা এসব সমস্যাকে খুব একটা গায়ে মাখে না। তারা নিজেদের মতো করে পথ চলে। দিন-দুনিয়া নিয়ে তাদের তেমন কোনো ভাবনা নেই। তারা বাঁচার আনন্দেই বেঁচে থাকে। আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করে। তারা প্রয়োজনে মুখোশ খুলছে, আবার দরকার হলে পরছেও। তাদের দিন কাটে টাকা কামানোর ধান্দা অনুসন্ধান করে। আসলে আধুনিক মানুষ এখন টাকাপয়সা, সম্পত্তি ছাড়া অন্য কোনো ভাবনায় নিজেকে ভাসাতে তেমন আনন্দ বোধ করে না।

এই মানুষগুলোর কারণেই বাংলাদেশ অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি এখন পরিণত হয়েছে টাকা বানানোর সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ ভূখণ্ডে। মানুষ দেদার টাকা বানাচ্ছে। টাকা ওড়াচ্ছে। এ দেশের যে পরিমাণ মানুষ প্রতিদিন চিকিত্সা, ভ্রমণ, বিনোদন, কেনাকাটার জন্য বিদেশ যায়, সেটা কেবল উন্নত কোনো দেশের সঙ্গেই তুলনীয়।

বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশেই কিন্তু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক হওয়া সহজ কাজ নয়। অন্য সব দেশে এর জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়। একটু একটু করে, অনেক সাধ্য-সাধনার পর টাকার মালিক হওয়া যায়। ধনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়। পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও পুঁজি গড়ে ওঠে ধীরে এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। আমেরিকার বিল গেটস, ফোর্ড, কার্নেগি, রকফেলার; জার্মানির ক্রুপস, জাপানের মিত্সুবিশি, মিত্সুই থেকে শুরু করে ভারতের টাটা-বিড়লা পর্যন্ত কেউই পারমিটবাজি বা নিছক সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দুই-দশ বছরের মধ্যে নিঃসম্বল অবস্থা থেকে কোটিপতিতে পরিণত হননি।

কিন্তু বাংলাদেশে কোটিপতি হওয়ার জন্য তেমন কোনো সাধনা বা পরিশ্রম করতে হয় না; এখানে ‘অলৌকিক’ উপায়ে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া যায়। পাকিস্তান আমলে মাত্র ২২টি পরিবারের কোটিপতি হিসেবে খ্যাতি ছিল। ঐ ২২ পরিবারের কোটিপতি হওয়ার পেছনেও অবশ্য রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও ভোজবাজি কাজ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোটিপতি হওয়ার এই ধারা আরো অনেক বেশি বিকশিত হয়েছে। এখন আমাদের দেশে কোটিপতির মোট সংখ্যা কেউ জানে না। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাংলাদেশে এখন কোটিপতির সংখ্যা অন্তত ৫ লাখে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশে কোটিপতি সৃষ্টির এই যে জাদুকরি ব্যবস্থা, একে কি কোনোভাবে খাটো করে দেখা চলে? ২২ পরিবার থেকে অযুত-নিযুত কোটিপতি পরিবার—এটাই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সবচেয়ে বড় সুফল! পাকিস্তান আমলে এই ২২ পরিবারের ইচ্ছায় দেশ চলত। আর এখন এই নব্য কোটিপতিদের ইশারায় দেশ চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন কোটিপতির ছড়াছড়ি, কোটিপতির সংখ্যার দিক থেকে আমরা সম্ভবত খুব শিগিগর তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছে যাব। যদিও সামগ্রিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চারপেয়ে জন্তুদের জীবনযাত্রার মান আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক অনেক ভালো।

বিশিষ্ট সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী একবার দরবার-ই-জহুর কলামে লিখেছিলেন, সন্তান উত্পাদনের যেমন একটামাত্র প্রক্রিয়াই রয়েছে, তেমনি কোটিপতি হওয়া যায় একটামাত্র পন্থাতেই—চৌর্যবৃত্তি ও দুর্নীতির মাধ্যমে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সাধারণত আইনের আওতার মধ্যে এদিক-সেদিক অনেক ঝকমারি করে বড়লোক বা কোটিপতি হতে হয়। আর এখানে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার নিয়ম। রাতে ফাটা স্যান্ডেল, ছেঁড়া জুতা তো সকালেই নতুন বাড়ি, নতুন গাড়ি। এখানে এমনকি ভাঙা সুটকেসওয়ালাও কোটিপতি বনে যায়। আমাদের দেশের কোটিপতিরা নামকাওয়াস্তে শিল্পকারখানা দেখিয়ে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেন না। ওদিকে তথাকথিত এই শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘সিক’ দেখিয়ে আরো টাকা নেওয়ার অথবা ঋণ মওকুফের চেষ্টা চালান।

এ দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি বা বেসরকারিকরণের নামে পানির দামে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, এই প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে এখনো অব্যাহত রয়েছে। আর এসব প্রতিষ্ঠান কিনে যেমন, বেচেও তেমনি অনেকেই কোটিপতি বনে গেছেন। পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে কোটিপতি তৈরির পথ সুগম রাখা হয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য নিয়ে আদম পাচার, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসাসহ আরো নানা অবৈধ ব্যবসা করে এ দেশে কোটিপতি তৈরির এক মহা-আয়োজন জারি আছে। সরকারি লাইসেন্স-পারমিটবাজি, কমিশন-সুদ-ঘুষ, চাঁদাবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে কোটিপতি সৃষ্টির প্রয়াস তো আছেই। ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এবং তা মেরে দিয়ে কোটিপতি হওয়ার এমন কাহিনি পৃথিবীর অন্য কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এ এক আশ্চর্য নীতির দেশ বটে! এখানে রাজউকের কর্মচারীরাও কোটিপতি। বিমানবন্দর, কাস্টমের ঝাড়ুদারও কোটিপতি। তহসিল অফিসের কেরানি, টেক্সট বুক বোর্ডের পিয়ন, শিক্ষা অধিদপ্তরের দারোয়ান, পুলিশের সেপাই, আদালতের পেশকার প্রমুখ ব্যক্তিও অবৈধ আয়ের জোরে কোটিপতি। আর একবার কোটিপতি হয়ে গেলেই তাদের হাব-ভাব-স্বভাব সবকিছু পালটে যায়। তারা তখন দেশ নয়, বিদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। আরো-আরো অর্থ কামানোর অবারিত পথ খোঁজেন। শুধু টাকাই নয়, তখন একটু ক্ষমতার স্বাদও নিতে চান।

যা হোক, কম-বেশি সবাই বড়লোক হতে চান। কিন্তু আপনি যদি বড়লোক না হয়ে থাকেন, তাহলে বিপদ থেকে বেঁচে গেছেন। বড়লোক হওয়া এখন মহাবিপদ। কিন্তু কেন?

বড়লোক হলে আপনার গাড়ি থাকা স্বাভাবিক। আর গাড়ি থাকা মানে রাস্তায় মারাত্মক জ্যাম। জ্যামে পড়লে আপনি শেষ। এতে আপনার সময় নষ্ট। রাস্তায় কোনো জায়গায় এদিক-ওদিক কোনো গাড়িকে ঢুঁসা মারলে আপনাকে দিতে হবে ক্ষতিপূরণ। তা ছাড়া ড্রাইভার-ম্যাকানিকের চুরি-চামারি তো আছেই। তেল চুরি হতে পারে আপনার। গাড়ির পার্টস ঠিক করা তো আছেই। আবার এই পার্টস ঠিক করতে ধোলাইখালে গিয়ে আপনার আরো একটি পার্টস খোয়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। তাই বড়লোক না হয়ে আপনি বেঁচে গেছেন।

বড়লোক হলে কথার মধ্যে একটু-আধটু ইংরেজি বলতে হয়। ইংরেজি বলতে হবে একটা স্ট্যাটাস রক্ষার্থে। আপনি যদি ইংরেজি না জানেন, সেক্ষেত্রে স্ট্যাটাস রক্ষা করা আপনার জন্য মহাবিপদ। ইংরেজি বলতে গিয়ে আপনি হয়তো দাঁতের গোড়া নাড়িয়ে ফেলবেন। এতে বিরাট ঝামেলার মধ্যে পড়ে যেতে পারেন আপনি। মুখটাকে শুধু হুইল চেয়ারের মতো এদিক-ওদিক নাড়াতে পারবেন। কিছু বলতে পারবেন না। তাই বড়লোক না হয়ে ভালোই হয়েছে।

বড়লোকেরা অসুস্থ হয়। অসুস্থ হওয়া মানে আমাদের মতো কোনো সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নয়। তারা আমাদের দেশের কোনো হাসপাতালে ভর্তি হবেন না। ভর্তি হবেন থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মেরিকার মতো বড় বড় দেশে। এসব দেশে কোনো টাকার কারবার নেই। সব ডলারের কাজকারবার। ভর্তি হতে গিয়ে আপনার কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার খরচ হয়ে যাবে, কিন্তু আপনি এত ডলার পাবেন কোথায়? তাই আপনি বড়লোক না হয়ে জানে বেঁচে গেছেন।

বড়লোক না হয়ে আপনি বেঁচে গেছেন। কারণ বড়লোকেরা বিদেশি কুকুর পালে। বিদেশি কুকুরদের গোসল করাতে নানা শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হয়। তা ছাড়া নানা ধরনের বিদেশি কসমেটিকস লাগাতে হয় তাদের শরীর চাঙ্গা রাখার জন্য। কিন্তু এত এত কসমেটিকস কিনতে গেলে তো আপনি ফতুর হয়ে যাবেন। বড়লোক না হয়ে আপনি মহা ভালো কাজ করেছেন। কারণ বড়লোকেরা ড্রইংরুমে নানা দামি চিত্রকর্ম ঝুলিয়ে রাখে। আপনিও হয়তো এ রকম চিত্রকর্ম কিনে না বুঝে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। আর না বুঝে ঝোলানোর কারণে আপনি মেহমানের সামনে বেইজ্জতি হয়ে গেছেন। কারণ চিত্রকর্মের আগামাথাও আপনি বোঝেন না। চিত্রকর্মটি আপনি উল্টো করে ঝুলিয়ে দিয়েছেন।

বড়লোকেরা দামি দামি খাবার খায়। দামি ফাস্টফুড খায়। দামি দামি মাখন খায়। এতে করে তাদের শরীর মোটা ড্রাম হয়ে যায়, যার দরুণ নানা রোগ তাদের একে-৪৭ নিয়ে আক্রমণ করে। ফলে বিছানা তাদের পার্মানেন্ট ঠিকানা হয়ে যায়। বড়লোক না হলে আপনি এসব থেকে বেঁচে যাবেন।

বড়লোক হতে হলে আপনাকে দামি বাসাবাড়িতে থাকতে হবে। কোনো কারণে একবার ভূমিকম্প হলে আপনার দামি বাড়িটি ভেঙে আপনারই শরীরের ওপর পড়বে। এতে আপনার শরীরের হাড্ডি একটাও থাকবে বলে মনে হয় না। একদিকে বাড়িটি হারালেন, অন্যদিকে শরীরের হাড্ডিগুলোও গুঁড়া-গুঁড়া করে ফেললেন। লাভ কী হলো এত দামি বাড়ি দিয়ে? তাই বড়লোক না হয়ে ভালোই করেছেন!

লেখক: রম্য রচয়িতা

ইত্তেফাক/এমএএম