নির্বাচন হইল গণতন্ত্রের মৌলিক অধিকার এবং জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম নিয়ামক। অন্যভাবে বলা যায়, নির্বাচন জনগণের একটি পবিত্র অধিকার, ইহাকে অবহেলা করা মানে গণতন্ত্রকেই অবহেলা করা। এই অর্থে, নির্বাচনে অংশগ্র্রহণ করা কর্তব্যের অংশ। কেবল নির্বাচকমণ্ডলী বা ভোটার নহেন, রাজনৈতিক দলগুলিরও নির্বাচনে অবতীর্ণ হইবার দায় ও দায়িত্ব রহিয়াছে। অবশ্য এই ক্ষেত্রে নির্বাচনি প্রতিযোগিতাকে নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করিবার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও দায়িত্ববোধ মুখ্য বিষয় হিসাবে ধর্তব্য।
সদ্যসমাপ্ত পাকিস্তনের ১৬তম জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসিপি) উপর পক্ষপাতমূলক আচরণের বিস্তর অভিযোগ উঠিয়াছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৯ সদস্য নিহত হইয়াছেন নির্বাচনি সহিংসতায়। ফলাফল প্রকাশে কালবিলম্ব, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন পরিষেবা বন্ধ করিয়া রাখাসহ নজিরবিহীন সকল অভিযোগ তুলিয়াছেন বিভিন্ন দলের নেতারা। তবে মানিতেই হয়, ভোটের ফলাফল সম্পর্কে পূর্বানুমান থাকা সত্ত্বেও এই নির্বাচনে পাকিস্তানের নাগরিকেরা অংশ নিয়াছেন বেশ স্বপ্রণোদিত হইয়াই। এমনকি আলোচিত-সমালোচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তাহার দল পিটিআইয়ের নেতারা নির্বাচনের মাঠ ছাড়িয়া যান নাই শত প্রতিকূলতার মুখেও। নির্বাচনি ফলাফলে পিটিআইসমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আগাইয়া রহিয়াছেন বেশ খানিকটা; কিন্তু অনিশ্চয়তার ঘোর কাটে নাই। ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়াছেন বটে, তথাপি তাহাদের অদৃষ্টের চাবি এখনো রাজনীতির বেড়াজালেই ঝুলিতেছে।
উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রকৃত চিত্র ইহাই। নির্বাচন সর্বদাই ‘ফুল অব আনসার্টেনিটি’ হইলেও দুঃখজনকভাবে উন্নয়নশীল দেশের নির্বাচন যেন ‘পাতানো খেলা’। দলে দলে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পরও চূড়ান্ত ফলাফলে জনগণ ক্ষমতার চেয়ারে দেখিতে পায় এমন সকল ব্যক্তিকে, যিনি বা যাহারা দেশ ও দশের জন্য ভালো কিছু করার কথা চিন্তা করিয়াছেন কোন কস্মিনকালে, তাহা খুঁজিয়া পাওয়াই মুশকিল! এই কারণে নির্বাচনের পর ভোটারদের ন্যায় হতাশ হইতে হয় যোগ্য প্রার্থীদেরও, যিনি বা যাহারা প্রকৃতপক্ষে বুঝিয়া উঠিতে পারেন না কোথা হইতে কী হইল!
এই ধরনের সংস্কৃতি উন্নয়নশীল বিশ্বে চলিয়া আসিতেছে যুগের পর যুগ। এই সকল জনপদে কোন ভোট সুষ্ঠু হইয়াছে, তাহার হদিস পাওয়া অতিশয় দুষ্কর। ইহার পরও গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রাখিবার প্রশ্নে, জনগণের স্বার্থের কথা বিবেচনায় লইয়া নির্বাচনে অংশ নেন প্রকৃত ও সুস্থ ধারার রাজনৈতিক দল ও তাহার নেতারা। তবে নির্বাচনের নামে তাহাদের সহিত করা হয় মশকরা, রসিকতা। কখনো সূক্ষ্ম আবার কখনো স্থূল কারচুপির বলি হইতে হয়। ভোটের পূর্বে ও পরে বিরোধী বা ছোট দলের নেতাকর্মীকে ব্যাপক ধরপাকড়, মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় জেলজুলুম প্রভৃতির মাধ্যমে কার্যত নিষ্ক্রিয়, পঙ্গু করিয়া দেওয়া হয়। স্থানীয় কিংবা জাতীয় নির্বাচন—সকল ক্ষেত্রেই এই খেলা চলে।
এই সকল দেশে সর্বদাই বলা হয়, ‘নির্বাচন জনগণের অধিকার। ইহাকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করা সরকার ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব।’ তবে ভোটের মাঠে পরিলক্ষিত হয় এক ভিন্ন বাস্তবতা। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করিবার মহান দায়িত্ব যাহাদের উপরে ন্যস্ত থাকে, সেই রক্ষকেরাই অবতীর্ণ হন ভক্ষকের ভূমিকায়। নির্বাচনের বেশ পূর্ব দিয়া বিরোধী কিংবা সম্ভাব্য প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ঘরছাড়া, এলাকা ছাড়া করিয়া নিষ্ক্রিয় করা হয়। সরকারের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে এই সকল অপকর্ম চলে বিভিন্ন নামধারী নেতা এবং প্রশাসনের একশ্রেণির আমলা বা কর্মকর্তার যোগসাজশে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আড়াল হইতে কলকাঠি নাড়েন প্রশাসন বা সরকারের শীর্ষ মহলের কেহ কেহ। এইভাবে শেষ পর্যন্ত তাহারা রাজনৈতিক ফাঁয়দা হাসিল করে বটে; কিন্তু ইহার ফলে মহাসর্বনাশ হইয়া যায় দেশ ও জাতির।
পাকিস্তানে যেই ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়াছে, তাহার মধ্য দিয়া ‘অনিশ্চয়তা’ ব্যতীত কীই-বা অর্জিত হইল? বস্তুত, এই একই মডেলে উন্নয়নশীল বিশ্বে যেই সকল নির্বাচন আয়োজন করা হয়, তাহার মধ্য দিয়া দেশ ও জনগণের ঠিক কী লাভ হয়, তাহা গবেষণাসাপেক্ষ। পাতানো নির্বাচন চূড়ান্ত ফলাফলে কেবল জনদুর্ভোগ, অনিশ্চয়তা আর গণতন্ত্রের ধ্বংস ও বিপদ-ই ডাকিয়া আনে। ঠাট্টা, মশকরার এহেন নির্বাচনই উন্নয়নশীল বিশ্বের বড় দুঃখ।