প্রবাদ রহিয়াছে, অমঙ্গলকে উড়াইয়া দিয়ো না, তাহা মঙ্গলসমেত উড়িয়া যাইবে। ফসলের রোগ-বালাই ও ক্ষতিকর কীট দমনে সারা বিশ্বেই বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বিবিধ বালাইনাশকের ব্যবহার মাত্রা ছাড়াইয়া গিয়াছে। কিছুদিন পূর্বে ‘নেচার’ পত্রিকার একটি গবেষণা নিবন্ধে বলা হইয়াছে, পৃথিবীর অনেক এলাকায় কীটপতঙ্গের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের পথে। যেই সকল জায়গায় এই সংকট অনেক বেশি, সেইখানে কীটপতঙ্গের পরিমাণ ৫০ শতাংশের মতো কমিয়া গিয়াছে। আর কীটপতঙ্গের প্রজাতির সংখ্যা কমিয়াছে ২৭ শতাংশ।
গবেষকরা ইতিপূর্বে জানাইয়াছেন যে, স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে পরাগায়ন এবং খাদ্য উত্পাদনে পোকামাকড়ের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রহিয়াছে, সেই বিবেচনায় ইহা বলা অত্যুক্তি হইবে না—পোকামাকড় ধ্বংস হইয়া গেলে বা কমিয়া গেলে জনস্বাস্থ্য এবং আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়িবে। ইতিপূর্বে যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভ গলসন বলিয়াছেন যে, আমাদের ফসলের তিন-চতুর্থাংশের উত্পাদন নির্ভর করে কীটপতঙ্গের উপর। সুতরাং কীটপতঙ্গ কমিয়া গেলে ফসল উত্পাদন কমিতে শুরু করিবে। প্রকৃত অর্থে, পোকামাকড় যদি দুনিয়ায় না থাকে, তাহা হইলে আট শত কোটি মানুষকে খাওয়াইবার মতো ফসল উত্পাদিত হইবে না। আরো উদ্বেগজনক বিষয় হইল, কীটপতঙ্গের সংখ্যা কমিয়া যদি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সেইখান হইতে আর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফেরা সম্ভব নহে, তাহা হইলে ক্ষতি কতটা বড় হইবে—সেই ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনো তল খুঁজিয়া পাইতেছেন না। তবে বিজ্ঞানীরা ইহা জানেন যে, এই ক্ষতি কেবল কীটপতঙ্গের প্রজাতি ধ্বংসের মধ্যে থামিয়া থাকিবে না। শেষ পর্যন্ত একটা বিপর্যয়কর পরিণতি ডাকিয়া আনিবে কমবেশি। বিজ্ঞানীরা ইহাও বলিতেছেন, জলবায়ুসংকটের সঙ্গে ভূমির অতি ব্যবহার মিলিয়া বিপদ দ্বিগুণ করিয়া তুলিবে। কৃষি উত্পাদন বাড়াইতে প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংসের ঘটনা স্থানীয় জলবায়ুকে নাটকীয়ভাবে বদলাইয়া দিতে পারে।
ইতিপূর্বে দেখা গিয়াছে সারা বিশ্বে ইনসেকটিসাইডের (কীটনাশক) গড় ব্যবহার মাত্র ২২ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে ইহার হার ৩৯ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাত্ বৈশ্বিক ব্যবহার মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ। উদ্বেগের বিষয় হইল, বালাইনাশকের এমন ভারসাম্যহীন ব্যবহার প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য হুমকির পাশাপাশি কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকিরও কারণ হইয়া দাঁড়াইতেছে। দেশের শস্যখেতে ৬০৭ ধরনের পোকা দেখা যায়। ইহার মধ্যে মাত্র ২৩২টি বা ৩৮ শতাংশ পোকা ফসলের জন্য ক্ষতিকর। বাকি ৬২ শতাংশ কীটপতঙ্গ বা পোকা ফসলের জন্য সরাসরি বা পরোক্ষভাবে উপকারী। ইহার মধ্যে ১৮৩টি, অর্থাত্ ৩০ শতাংশের বেশি পোকা সরাসরি ফসলের জন্য উপকারী। অন্যদিকে ১৯২টি পোকা ক্ষতিকর পোকা খাইয়া বা পরজীবী ও পরভোজী হিসাবে ফসলের উপকার করিয়া থাকে। কিন্তু নির্বিচার কীটনাশকের ব্যবহারে উপকারী এইসব পোকাও ধ্বংস হইয়া যায়।
কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈধ ব্যবহার একটি অতি জরুরি বিষয়। বৈধ ব্যবহার নিশ্চিতে মূলত কীটনাশকটি রোগ-বালাইয়ের জন্য একান্তই প্রয়োজনীয় কি না, পারিপার্শ্বিকতা ও রোগ-বালাইয়ের ধরন বিবেচনা করিয়া কতটুকু ও কখন ব্যবহার করা দরকার, ফসল সংগ্রহের পর অবশিষ্টাংশের মাত্রা খাদ্যে বা পরিবেশের ক্ষতি করিতে পারে কি না—প্রভৃতি বিষয় গুরুত্বের সহিত বিবেচনায় লইতে হয়। বলিবার অপেক্ষা রাখে না, উন্নত দেশগুলিতে এই সকল বিষয় যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়। কিন্তু দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশে কীটনাশকের বৈধ ব্যবহারের নীতিমালা সঠিকভাবে পালন করা হয় না। দেখা যাইতেছে, শস্য আবাদ এবং পোকা দমনে ভুল পদ্ধতি প্রয়োগের কারণেই কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার বাড়িতেছে। পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রকৃতির পাশাপাশি কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বৃদ্ধি পাইতেছে। কীটনাশক মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে নদী-নালা ও অন্যান্য জলাধারে এখন আগের মতো ছোট মাছ পাওয়া যায় না। ব্যাহত হইতেছে মানুষের জন্যও নিরাপদ ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যের সংস্থান। সুতরাং জনস্বাস্থ্য ও বাস্তুতন্ত্র উভয়ের সুরক্ষার জন্যই কীটনাশক ব্যবহারে সচেতনতা সংশ্লিষ্ট মহলের সর্বস্তরে ছড়াইয়া দিতে হইবে।