আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা যথেষ্ট বেড়েছে। বিষয়টি দলের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে সচেতন মহলকেও যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে। সংগত কারণেই আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির মাঠে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ানোর শঙ্কাও লক্ষ করা যাচ্ছে। এ জন্য এই মুহূর্তে দলের ভেতরের চেইন অব কমান্ড বিনষ্ট হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। দলের সাংগঠনিক ভিত্তি এবং চেইন অব কমান্ড অক্ষুণ্ন ও মজবুত রেখে আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার বিষয়টি যেকোনো দলের জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। আওয়ামী লীগ তথা সরকারের আগামীর পথ চলার ক্ষেত্র সুপ্রসন্ন রাখতে না পারলে নিজেরাই নিজেদের শক্ত বাধা হিসেবে সামনে আসার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এছাড়া দেশের সকল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ এবং সাধারণ জনগণের শঙ্কাহীন শান্তিপূর্ণ চলাফেরা ও বসবাসের নিশ্চয়তার চ্যালেঞ্জটি এই মুহূর্তে সরকারের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি গণভবনে আওয়ামী লী?গের বি?শেষ বর্ধিত সভায় প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি ও মজুতদারি বন্ধে জনপ্রতিনিধিদের কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সব জায়গায় চাঁদাবাজি ও মজুতদারি বন্ধ করতে হবে। আপনারা বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধি, এতে আপনাদেরও নজর দিতে হবে। একদিকে কৃষক যাতে প্রকৃত মূল্যটা পান, সেদিকে নজর দিতে হবে। অন্যদিকে, এই অহেতুক চাঁদাবাজি ও মজুতদারির জন্য যাতে পণ্যের দাম না বাড়ে, সেটি দেখতে হবে।’
ভোটকেন্দ্রে ভোটার নিশ্চিত করতে এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা ঠেকাতে দলের নেতা-কর্মীসহ সবার জন্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রার্থিতার বিষয়টি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য দলের ভেতরেই যে মনকষাকষি এবং পালটাপালটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে, এটি স্পষ্ট। এ বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বর্ধিত সভায় বলেন, ‘আমাদের অনেকেই নির্বাচন করেছেন। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে মনকষাকষি আছে। দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। এখন এক হয়ে কাজ করতে হবে। কোথাও কোনো সমস্যা হলে আমরা সমাধান করব। কিন্তু নিজেরা আত্মঘাতী সংঘাতে লিপ্ত হওয়া যাবে না। এবার নৌকার জোয়ার ছিল, এই জোয়ারেও জিততে না পেরে একে-ওকে দোষারোপ করে লাভ নেই।’
এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশনকে বেশ কিছু বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে আইন করে। যে যেভাবেই বিতর্ক করুক না কেন, এবারের নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হলেও সেটি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে বলে অনেকে স্বীকার করেছেন। বিএনপি নির্বাচনে এলে বিষয়টি আরো উত্সবমুখর হতো—সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ক্ষমতার ফলে তারা প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে নির্বাচনের আয়োজন করেছে। সরকারদলীয় প্রার্থী ও কর্মীদের জেল-জরিমানা করতে তারা মোটেও পিছপা হয়নি। তাদের পদক্ষেপ গ্রহণের বিভিন্ন ধরন দেখে প্রমাণিত হয়েছে যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে কমিশন যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। যদিও কোথাও কোথাও ব্যর্থও হয়েছে।
নির্বাচন-পরবর্তী সাধারণ জনগণের অনেক প্রত্যাশা বেড়েছে। জনগণের জন্য সেবা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। বিশেষ করে নানাবিধ অরাজকতা, লুটতরাজ, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য প্রভৃতি থেকে দেশকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করার বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি। অপরাধীরা যেন মনে না করে যে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশ্রয়ের সুযোগ নিয়ে তারা পার পেয়ে যাবে। অপরাধ করেও তাদের কিছু হবে না। এই ভাবনা তাদের বেপরোয়া করে তুলতে পারে। ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। সুশাসন ও জবাবদিহিমূলক সরকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান দুর্বলতা চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সরকারি দলের রাজনীতিকেরা অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপচর্চা করেন। ফলে অপরাধ বেড়ে যায়। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছত্রছায়ায় এসব অপরাধী পার পেয়ে যায়। অনেকেই সরাসরি রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হন।
আমরা জানি, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসে, ক্ষমতায় থেকে যায়। আর এই ক্ষমতায় আসা এবং ক্ষমতায় থাকার মানদণ্ড হলো জনগণের পূর্ণ সমর্থন। জনগণের সমর্থনের ঘাটতি হয় এমন আচরণ কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের থাকা উচিত নয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে রাতারাতি অনুপ্রবেশকারী সুবিধাবাদীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাজনৈতিক দলের ভাবমূর্তি। সেদিকেও বিশেষ লক্ষ রাখা দরকার সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর। সরকারের ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি’ বিদ্যমান থাকলেও দুর্নীতি এখনো বন্ধ হয়নি। এর মূলোত্পাটন করা সহজ না হলেও হাল ছাড়া যাবে না। সাধারণ মানুষের অফিস-আদালতের কোনো কাজ স্বাভাবিকভাবে হওয়া খুব কঠিন। এর জন্য কারো কাছে ধরনা দিতে হয়, তদবির করতে হয়, স্পিড মানি দিতে হয়, আবার অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ছাড়পত্র ছাড়া হয় না। এমন নানা ধরনের বাস্তবতা আমাদের আঁকড়ে ধরেছে। এটি সুশাসনের লক্ষণ নয়।
রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করার কারণে দুর্নীতি ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাই রাজনীতিকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে যাবতীয় সন্ত্রাস, রাহাজানি, টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত হন। আর আমরাও এর উপায় খুঁজে না পেয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছি।
সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ক্রমাগতভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং দুর্নীতির মাত্রা কমিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা থাকলেও তৃণমূলে সেগুলো সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ অনুসন্ধান নিয়ে নানা সময়ে নানা প্রতিবেদন লক্ষ করেছি। বিভিন্ন প্রতিবেদনে লক্ষ করা গেছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই সরকারি দলের কর্মী, সমর্থক কিংবা খোদ রাজনৈতিক নেতা। তাদের ক্ষমতার দম্ভের কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি অনেকটা দৃশ্যমান। কাজেই এ বিষয়ে সতর্ক হয়ে সরকার আগামীর উন্নয়ন ও স্বস্তির যাত্রায় সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক :অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়