শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩০ মাঘ ১৪৩১
The Daily Ittefaq

যুদ্ধ নয়, ধ্বংসের খেলা

আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৩০

এই বছরের শুরুর দিকে গাজা উপৎযকায় গিয়েছিলাম। ভার্জিনিয়া থেকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ছুটে যাওয়ার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল স্বেচ্ছাসেবক শল্যচিকিৎসক হিসেবে মানবিক সহায়তাগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করা। ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় মৃৎযুপুরীতে পরিণত হওয়া গাজার মানুষকে চিকিৎসা সেবাদানকারী চিকিৎসক ও নার্সদের দলে যোগ দিই আমি।

এর আগেও বিভিন্ন যুদ্ধকবলিত এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। তবে গাজার পরিস্থিতি আমাকে হতবাক করেছে। টানা ১০ দিন এই উপৎযকায় আমি যা দেখেছি, তা কোনো দিনও ভোলার নয়! সৎযি বলতে, গাজায় যা চলছে, তাকে যুদ্ধ না বলে ‘ধ্বংসের খেলা’ বলা ঠিক হবে।

গাজায় ইসরাইলের অবিরাম বোমাবর্ষণে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। দুঃখজনক হলো, নিহতদের বেশির ভাগই শিশু ও নারী। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যকার এই সংঘাতে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, বলা যায়।

মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে যাৎরা করে রাফাহ সীমান্তে থামি আমরা। এই যাৎরাপথে আমরা দেখেছি, মানবিক সহায়তা নিয়ে ট্রাকগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ৎরাণ কিংবা চিকিৎসা সরঞ্জামে বোঝাই সেই সব ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতির অপেক্ষায় রীতিমতো প্রহর গুনছিল। মাইলের পর মাইল লম্বা সেই ট্রাকের লাইন!

গাজায় পৌঁছে আমরা যা দেখতে পাই, তাকে এক কথায় বলা যায় ‘ধ্বংসলীলার আখ্যান’। মুহুর্মুহু বোমার শব্দে আমাদের কান অসাড় হয়ে আসছিল। নজরদারি ড্রোন ক্রমাগত চক্কর কাটছিল। নানামুখী বিপৎতি ঘিরে ধরছিল আমাদের!

আমরা যেখানে অবস্থান করছিলাম, তার পাশেই ছিল ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষের আশ্রয়শিবির। পর্যাপ্ত স্যানিটেশন না থাকার কারণে কী মাৎরায় দুর্গন্ধ আমাদের নাকে আসছিল, তা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন? আমাদের দৃষ্টি হারিয়ে যাচ্ছিল তাঁবুর সাগরে—একটার পর একটা তাঁবু মিলিয়ে গেছে দূর দিগন্তে!

রাফাহ শহরের এক গেস্ট হাউজে উঠেছিলাম আমরা। প্রচণ্ড ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে প্রথম রাত ঘুমাতে পারেননি অনেকেই। বরং বারান্দায় দাঁড়িয়ে বোমার শব্দ শুনছিলাম আমরা। খান ইউনিস থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে আঁতকে উঠছিলাম।

পরের দিন একটি ইউরোপীয় হাসপাতালে কাজ করতে যাই আমরা। সে এক বীভৎস দৃশ্য! সেখানে সারি সারি অস্থায়ী তাঁবু ছিল। হাসপাতালে আসছিল শয়ে শয়ে আহত ফিলিস্তিনি। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মারা যাচ্ছিল। তাঁবুর সারি ও লোকজনের ভিড়ে রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছিল বারবার।

গাজার হাসপাতালগুলোর অবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা এই একটি হাসপাতালের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। এই হাসপাতালে সাকল্যে ৩০০ জন রোগীর চিকিৎসা নেওয়ার কথা থাকলেও হাজার হাজার রোগী আমাদের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। সেবার জন্য রীতিমতো লড়াই করছিল আরো শত শত রোগী ও আশ্রয়প্রার্থী। আহত মানুষের আর্তনাদে পরিস্থিতি কতটা মর্মান্তিক হয়ে ওঠে, নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না।

গাজায় খুব অল্প কজন স্থানীয় সার্জন চিকিৎসাসেবা দিচ্ছিলেন। আমাদের আগেই বলা হয়েছিল, অনেক সার্জনকে হৎযা বা গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকের হদিস পর্যন্ত নেই। অনেকে বিভিন্ন জায়গায় আটকা পড়ে আছেন বিধায় কাজে ফিরতে পারছেন না। কেবল একজন স্থানীয় প্লাস্টিক সার্জন কাজ করার পর্যায়ে ছিলেন এবং কাজ করে যাচ্ছিলেন ২৪ ঘণ্টাই। সপ্তাহের সাত দিনই কাজ করতে হচ্ছিল তাকে। ঐ সার্জনের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে বোমার আঘাতে। এ কারণে হাসপাতালেই থাকতেন তিনি। এই সার্জন ভাগ্যবান এ কারণে যে, তার স্ৎরী ও একমাৎর কন্যা তখনো জীবিত ছিলেন। অন্যদিকে হাসপাতালে কর্মরত প্রায় সবাই তাদের প্রিয়জন হারানোর শোক বুকের মধ্যে পুষে রেখেই কাজ করে যাচ্ছিলেন বলে আমরা শুনেছিলাম!

এসব ঘটনা-দুর্ঘটনার গল্পের মধ্যেই কাজে লেগে পড়ি আমরা। অবস্থা এতটা শোচনীয় হয়ে পড়ে যে, দৈনিক ১০ থেকে ১২টি অস্ৎরোপচার করতে হতো। টানা ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ চালিয়ে যেতে হতো। এতটুকুতেই নিস্তার মিলত না, অবিরাম বোমা বিস্ফোরণে প্রায়ই কেঁপে কেঁপে উঠত অপারেটিং রুম। এমনো হয়েছে বহু বার, প্রতি ৩০ সেকেন্ড অন্তর বোমার শব্দে কেঁপে উঠতাম আমরা!

কী ধরনের বাজে পরিবেশে কাজ করতে হয়েছে আমাদের, তা কল্পনারও বাইরে। চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতিতে হিমশিম খেতে হতো অধিকাংশ ক্ষেৎরেই। এমন অনেক বার ঘটেছে, রোগীর সংকাটপন্ন অবস্থা বিবেচনায় পা কিংবা শরীরের কোনো অংশ কেটে ফেলতে বাধ্য হতাম। যদি মানসম্মত চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে অনেক অঙ্গচ্ছেদ এড়ানো যেত নিশ্চিতভাবে।

গাজায় স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এরকম অবস্থায় আহত রোগীদের যৎন নেওয়া বা চিকিৎসা দেওয়া কতটা কঠিন, তা আমরা বুঝেছি প্রতি মুহূর্তে। এসবের মধ্যেই রোগীদের কথা শুনতাম আমি। ফিসফিস করে নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া করুণ গল্প বলত তারা। আমি কত জন এতিম শিশুর অপারেশন করেছি, তার হিসাব রাখা একসময় বন্ধ করে দিই। রোগীর চাপ এত বেশি ছিল যে, হিসাব রাখার সময় ও সুযোগ কোনোটাই থাকত না!

একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। ৫ থেকে ৮ বছর বয়সি কয়েক জন শিশুকে একবার জরুরি কক্ষে নিয়ে আসা হয়। সবার মাথায় মারাৎমক আঘাত ছিল। তাদের কাউকেই বাঁচানো যায়নি! বিষয়টি আমাকে পীড়া দেয় ভীষণভাবে। খুব করে মনে পড়ে গাজায় আমার শেষ দিনকার কথা। গেস্ট হাউজে বসে আছি। এক ছোট্ট শিশু দৌড়ে এসে আমাকে একটি গিফট দেয়। এটা ছিল সমুদ্রসৈকতে কুড়িয়ে পাওয়া একটি পাথরবিশেষ। পাথরের গায়ে আরবি হরফে লেখা ছিল—‘আঘাতজর্জরিত গাজায় বসেও তোমার প্রতি ভালোবাসা জানাই’। এ কথা আমার কানে বাজে সব সময়ই।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাফাহ শহরকে যখন শেষ বারের মতো দেখছিলাম, তখনো ড্রোন, বোমা বিস্ফোরণ ও মেশিনগানের ফায়ারের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম অবিরাম। আতঙ্ক কেবল বাড়ছিল। কারণ, বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারছিলাম, বিস্ফোরণ ঘটছে খুব কাছেই।

সম্প্রতি ইসরাইলি বাহিনী গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছে বলে খবরে জানা গেছে। এমনকি রাফাহে স্থল আক্রমণের পরিকল্পনা করছে ইসরাইলি সেনারা। ঠিক এমন একটি অবস্থায় সৎযিই নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে আমার। এর কারণ, গাজার চরম দুরবস্থার মধ্যেই চলে আসতে বাধ্য হই আমরা। আমি ও আমার টিম সেখানে থাকার সুযোগ পাইনি।

গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলমান সংঘাতে যেভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রাণ ঝরছে, তা ব্যথিত করেছে সারা বিশ্বের মানুষকে। আমার মতো যারা কাছ থেকে গাজার বিভীষিকা প্রৎযক্ষ করার উপলক্ষ্য পেয়েছে, তারা জানে ঠিক কী চলছে এই উপৎযকা জুড়ে!

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, যুদ্ধ সব সময়ই শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাৎমক প্রভাব ফেলে। গাজার শিশুদের অবস্থা আরো বিভীষিকাময়। এই অবস্থায় গাজার ১০ লাখেরও বেশি শিশুর জরুরি ভিৎতিতে মানসিক সহায়তা প্রয়োজন।

যুদ্ধকবিলত গাজার শিশুরা যেসব সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে, তার মধ্যে রয়েছে উচ্চমাৎরার আতঙ্ক ও উদ্বেগ, ক্ষুধা হ্রাস, ঘুমাতে না পারা ইৎযাদি। সব থেকে বড় কথা, যখনই বোমা হামলার শব্দ তাদের কানে যাচ্ছে, চরম মানসিক অস্থিরতা ও আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে তারা।

গাজা যুদ্ধ বন্ধের কথা শোনা যাচ্ছে বটে, কিন্তু যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বরং গাজায় বেড়েই চলেছে শিশু ও মাতৃমৃৎযু। অনুমান করা হচ্ছে, গাজায় এখনো প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর একটি শিশু মারা যাচ্ছে। আরো উদ্বেগজনক খবর হলো, প্রতি ঘণ্টায় মারা যাচ্ছেন অন্তত দুই জন মা। এই অবস্থা চলতে থাকলে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড কোন পর্যায়ে উপনীত হবে, তা ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়।

লেখক: মার্কিন চিকিৎসক

লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস থেকে অনুবাদ :সুমৃৎ খান সুজন

 

ইত্তেফাক/এমএএম