তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইলে, তাহা কতখানি সুষ্ঠু বা অসুষ্ঠু হইল—এই সার্টিফিকেট লইতে হয় পশ্চিমাদের নিকট হইতে। কিন্তু সম্প্রতি পাকিস্তান যেন তৃতীয় বিশ্বের এই প্রবণতার বিপরীতে ভিন্ন উদাহরণ সৃষ্টি করিল। গত ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দেশটির প্রাদেশিক বিধানসভায় নির্বাচন কমিশন দ্বারা বিজয়ী ঘোষিত হাফিজ নাঈম উর রেহমান নিজের বিজয় প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিয়াছেন যে, কেহ যদি তাহাদের অবৈধ উপায়ে জিতাইতে চাহে, ইহা তাহারা মানিয়া লইবেন না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন যে, জনমতকে সম্মান করিতে হইবে। বিজয়ীকে জিতিতে দিন, পরাজিতকে হারিতে দিন। তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা হইল—নাঈম উর রেহমানের ঘোষণার পর বিবেকের বোমা ফাটাইয়াছেন রাওয়ালপিন্ডি বিভাগের কমিশনার লিয়াকত আলি চাত্তা। তিনি নির্বাচনে অনিয়মের দায় স্বীকার করিয়া নিজের বিচার নিজেই দাবি করেন। এই আমলা বিচার চাহিয়াছেন শীর্ষপর্যায়ের আরো দুই জনের।
দেখা যাইতেছে, পাকিস্তানের নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয় নাই, সেই কথা সেই দেশের লোকেরাই বলিতেছে। ইহাকে কি বলা যাইতে পারে—পাকিস্তানের নূতন ইতিবাচক ট্রান্সফরমেশন? পাকিস্তান লইয়া অনেক ধরনের নেতিবাচক কথাই ইথারে ভাসিয়া বেড়ায়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর এখন অবধি এই দেশটিতে একজন প্রধানমন্ত্রীও মেয়াদ পূর্ণ করিতে পারেন নাই। বলা যায়, মেয়াদ পূর্ণ করিতে দেওয়া হয় নাই। বিশ্লেষকরা বলিয়া থাকেন, দেশটির নেপথ্য শাসক মূলত সেনাবাহিনী। তাহারা কখনো সখনো সরাসরিই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে সেনাশাসন মানেই তো সংবিধান স্থগিত হইয়া যাওয়া। ১৯৪৭ হইতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছয় দশকে অর্ধেকেরও বেশি সময় অর্থাত্ ৩৩ বত্সর পাকিস্তান ছিল সরাসরি সেনাশাসনের আওতায়। ২০০৮ সালের পর হইতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বত্সরে দেশটিতে ছয় জন প্রধানমন্ত্রী সরকার গঠন করিয়াছেন, কিন্তু কোনো সরকারই মেয়াদ পূর্ণ করিতে পারে নাই। যদিও সর্বশেষ অবসরে যাওয়া সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া তাহার বিদায়ি ভাষণে বলিয়াছিলেন, সেনাবাহিনী নিজেদের রাজনীতি হইতে দূরে রাখিবে। তবে অনেকেই মনে করেন, ইহা যেন বিড়ালের মাছ না খাইবার অঙ্গীকার। কিন্তু এত খারাপের মধ্যেও বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাকিস্তানের নির্বাহী প্রতিষ্ঠানগুলি মোটামুটি চাপের মুখেও কাজ করিতে চেষ্টা করে। যদিও অতীতে পাকিস্তানে যেই তিন বার সামরিক শাসন জারি হইয়াছে, প্রতিবারই তাহাকে বৈধতা দিয়াছে দেশটির আদালত। তবে পাকিস্তানের আদালতের এবং বিচারকদের অন্য ধরনের ভূমিকাও আমরা দেখিতে পাই। জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৮১ সালের সাময়িক সংবিধান আইন (পিসিও) জারির মাধ্যমে এই আদেশের সঙ্গে সম্মত হইয়া সকল বিচারকের জন্য নূতন করে শপথ নেওয়া বাধ্যতামূলক করেন। কিন্তু তাহাতে অসম্মতি জানান ১৬ জন বিচারক। বিচারকদের মধ্যে সংবিধান এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধার একটি উদাহরণ হইয়া উঠে এই ঘটনা। দেশটিকে আদালতের বড় ধরনের ভূমিকা দেখা যায় ১৯৯৩ সালে। সেই সময় নওয়াজ শরিফ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করিতে পার্লামেন্ট ভাঙিয়া দেন প্রেসিডেন্ট গুলাম ইসহাক খান। আদালতের রায়ে নওয়াজ শরিফ ক্ষমতা ফিরিয়া পান মে মাসে। নির্বাহী বিভাগ, বিশেষ করিয়া প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিচারপতি এবং আদালতের অবস্থান কতটা শক্তিশালী, তাহা বোঝা যায় ২০০৭ সালের মার্চ মাসে প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মুহাম্মদ চৌধুরীকে বরখাস্ত করিবার পর। প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারা দেশে গড়িয়া উঠে আন্দোলন। সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্টের সেই সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক বলিয়া চিহ্নিত করে এবং প্রধান বিচারপতিকে স্বপদে বহাল করা হয়। ২০০৭ সালের অক্টোবর অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বৈধতাকে আদালত চ্যালেঞ্জ করিলে প্রেসিডেন্ট মোশাররফ প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীসহ ষাট বিচারপতিকে বরখাস্ত করেন এবং প্রধান বিচারপতিসহ শীর্ষস্থানীয় বিচারপতিদের গৃহবন্দি করেন। এই অবস্থার বিরুদ্ধে গড়িয়া উঠা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পতন ঘটে মোশাররফের। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে তাহাকে আদালত শাস্তি প্রদান করেন এবং শেষ পর্যন্ত তাহাকে পদত্যাগ করিতে বাধ্য করে পাকিস্তানের আদালত।
সুতরাং বিশ্লেষকরা মনে করিতেছেন, সর্বশেষ নির্বাচনের অভাবিত প্রেক্ষাপটে সম্ভবত দেশটির সেনাবাহিনী এই উপলব্ধি করিতে পারিয়াছে, সকল ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ করিয়া সকল কিছু বাঁকানো ঠিক নহে। বরং অধিক শক্তি প্রয়োগ করিয়া বাঁকাইতে গেলে তাহাতে জিনিসটি ভাঙিয়াও যাইতে পারে। ইহার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে। সেই জন্য বিশ্লেষকরা মনে করিতেছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মধ্যে হয়তো নূতন বোধোদয় আসিতে পারে।