মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৫ ফাল্গুন ১৪৩১
The Daily Ittefaq

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা

আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৩০

বাংলাদেশে বসবাসরত প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা থাকলেও তাদের মধ্যে বেশির ভাগের ভাষারই নেই নিজস্ব বর্ণমালা। লিখিত রূপ না থাকায় তাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে তাদের অবলুপ্তিও যেন ত্বরান্বিত হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাই হচ্ছে, কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষাই হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। আর এ দায়িত্ব শুধু বাঙালির নয়, পৃথিবীর সব মানুষের। আমরা যেন শুধু আবেগতাড়িত হয়ে অমর একুশের কথা না বলি।

ভাষা আন্দোলনের চেতনা তখনই সার্থক হবে, যখন প্রতিটি জনগোষ্ঠী তার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে। মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারবে। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে। শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যে বিষয়টি যুক্ত, তা হলো নিজস্ব ভাষা। ভাষা মানুষের আত্মবিকাশের পথ সম্প্রসারণ করে। এ জন্য একজন মানুষ তার ভাষা প্রয়োগে যতটা দক্ষতা অর্জন করবেন, জীবনের নানা ক্ষেত্রে তিনি ততটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন।

এ জন্য বাস্তবিক কারণেই একজন আধুনিক মানুষকে আরো দক্ষ, যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য ভাষার ওপর পূর্ণ দখল থাকা চাই, সেটা অবশ্যই তার মাতৃভাষা। এর সঙ্গে অন্য ভাষা যত শেখা যায়, ততই মঙ্গল। বস্তুত একুশের পথ ধরেই এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু যে চেতনা ধারণ করে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে এই ছয় দশকে? স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমেই প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ণতা পায়।

এ কারণে আশা করা হয়েছিল, রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। দেশের সব মানুষ তার নিজের ভাষায় লিখতে-পড়তে পারবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো অক্ষরজ্ঞানহীন। তাই ভাষা আন্দোলন এখনো শেষ হয়ে যায়নি। প্রতিটি মানুষকে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে তুলতে না পারলে, তাদের শিক্ষিত করে তোলা না গেলে একুশের চেতনা বাস্তবায়নও হবে অসম্ভব।

বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। দুঃখজনক হচ্ছে, নৃগোষ্ঠীগুলোর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সামগ্রিক রূপটি বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালিদের কাছে অনেকটাই অপরিচিত রয়ে গেছে। এর রয়েছে নানা কারণ। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। এর পেছনেও সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। সুদূর অতীতকালে তারা যখন এতদঞ্চলে অভিবাসন শুরু করে, তখন আগের বাসস্থলের ভৌগোলিক আবহের সঙ্গে যে অঞ্চলের মিল পেয়েছে, সেখানেই তৈরি করেছে আবাসন। এর ফলে ভৌগোলিকভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালিদের সঙ্গে এদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। নৃগোষ্ঠীগুলোর প্রাচীন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষারীতি কালের স্রোতে বাহিত হয়ে চলেছে তাদের সমাজে। নিজেদের গুটিয়ে রাখতে, তাদের আচরিত জীবনযাপন পদ্ধতি ও ভাষারীতি যতটা সম্ভব আঁকড়ে থাকতে তারা সদা তত্পর। তাদের ঔজ্জ্বল্যটুকু ধরে রাখতে পারলে সর্বসাধারণ্যে তুলে ধরতে পারলে শুধু সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীই নয়, সামগ্রিকভাবে উপকৃত হবে সবাই। এ জন্যই বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সারল্যে ভরা জীবনাচারের অধিকারী ক্ষুদ্র এসব নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে সবাইকে কৌতূহলী করে তোলা একান্ত অপরিহার্য।

বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন সংখ্যালঘুতার কারণে বঞ্চিত জীবনের ভার বইতে বইতে গুটিয়ে গেছে নিজেদের মধ্যে। কখনো বিসর্জন দিয়েছে আত্মপরিচয়, নাম, গোত্র, এমনকি ধর্মবিশ্বাস পর্যন্ত। অধিকারবঞ্চিত এসব নৃগোষ্ঠীর অনেকে বর্ণহীন বলেই তাদের জীবনের সুমহান বাণী লিপিবদ্ধ হয়নি মাতৃভাষায়। তাই তো তারা আজ বিলুপ্তির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। কিন্তু লিখিত বর্ণমালা না থাকা সত্ত্বেও নিসর্গকেন্দ্রিক জীবনে তাদের উত্সব, পার্বণ, নৃত্য, গীতিনাট্য, গীতিকা, পালা ইত্যাদি শিল্প এবং নানা রকম ক্রীড়া-কসরত গড়ে ওঠে জুমকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।

এদিকে বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হলেও এক্ষেত্রে রয়েছে নানা সমস্যা। এজন্য প্রথমেই এই বাংলা ভাষার গাঁথুনি শক্ত করতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষা সচেতনতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। সমস্যা হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম না বাংলা, না ইংরেজি কোনো ভাষাই ভালোভাবে শিখছে না। ভাষার বিকৃতি ঘটছে চরমভাবে।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে তথ্য-প্রযুক্তির চরম উত্কর্ষ সাধিত হয়েছে। ফেসবুক-ইন্টারনেটে যোগাযোগের ক্ষেত্রে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত ভাষা। রোমান হরফে বাংলা লেখা হচ্ছে। সেই বাংলার ধরনও আবার বড়ই বিচিত্র। এফএম রেডিওর বিরুদ্ধে ভাষাবিকৃতির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এ জন্য গণমাধ্যমের ভাষার ব্যাপারে একটা নীতিমালা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, বিশেষ করে যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু তাই বলে নিজস্ব সত্তা বিসর্জন দিয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে হবে? এই আত্মবিনাশের পথ থেকে আমাদের ফিরে আসতে হবে। লেখায়, বলায়, পঠন-পাঠনে সর্বত্র বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে মর্যাদার আসনে। মনে রাখতে হবে, একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু আমাদের নিজস্ব ব্যাপার নয়। এটি এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও। এমনকি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে।

আগেই বলেছি, আমাদের দেশে অনেক ক্ষদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে। এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন এ দেশেরই নাগরিক, অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো তাদেরও এই দেশের জল-হাওয়া সমানভাবে স্পর্শ করে। এই সব নৃগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি। রয়েছে নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠানও। ঐতিহাসিক কাল থেকেই তারা এ দেশে বসবাস করছে। এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে তারা আমাদের সংস্কৃতিকে করছে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও পরিপুষ্ট। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষা-সংস্কৃতি। অথচ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করা প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার। যেকোনো মূল্যে সেই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

যে চেতনায় আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর কথা বলি, একই চেতনায় বাংলাদেশে সব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষার কথাও বলতে হবে। কারণ যার যার মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্যই সালাম বরকত রফিক শফিক জব্বাররা তাদের জীবন উত্সর্গ করেছেন। সেই চেতনা ধারণ করলে কোনো ভাষাগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য করার কোনো সুযোগ নেই। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এই ফেব্রুয়ারিতে আমাদের শপথ নিতে হবে সব গোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষা করার। তবেই সার্থক হবে ভাষাশহিদদের আত্মদান।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

ইত্তেফাক/এমএএম