মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৫ ফাল্গুন ১৪৩১
The Daily Ittefaq

অর্জুন বিশ্বাসের গান সময়ের সমাজদর্পণ

আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৫:৩০

অর্জুন বিশ্বাস এক দ্রোহী শিল্পীসত্তা, এক মানবতাবাদী কণ্ঠস্বর। তার গান জীবনের কথা বলে, মানুষের কথা বলে। সমাজের অসংগতিকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। অবিরল ঝরনাধারার মতো প্রবাহিত হয় তার সহজিয়া কথার স্ফুরণ। মুখে মুখে গান বাঁধা বাংলার চারণকবিদেরই যোগ্য উত্তরসূরি তিনি। তার গানে রয়েছে ছন্দ ও অনুপ্রাসের চমত্কার ব্যবহার। গানের কবিতায় তির্যক তির ছুড়ে দেওয়া তার সহজাত। প্রকাশভঙ্গি ঋজু। সত্য কথাটি বলতে তিনি রূপকের আশ্রয় নেন না, যা বলেন সোজাসাপটা। এটাই গণমানুষের কবি ও শিল্পী অর্জুন বিশ্বাসের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

সম্প্রতি প্রকাশ পেল তার জীবনচিত্র ও গানের সমাহার নিয়ে সংকলন ‘কাঁচা সোনা-২ : জীবন ছোঁয়া গানের মানুষ অর্জুন বিশ্বাসের জীবন ও গান’। ৪১৬ পৃষ্ঠার এই ঢাউস বইটি সম্পাদনা করেছেন লেখক ও গবেষক সুমন শিকদার। ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘মূলত চেতনা ও কর্মমুখরতার ওপর ভিত্তি করেই নিজেদের বিশ্বাস এবং বিনোদন সাজানো দরকার। নানামুখী অসংগতিই মানুষকে, মানুষের মননকে আঘাত করে, মানুষ তার নিজের কথা, মানবতার কথা বলতে শুরু করে।’ অর্জুন বিশ্বাসও তার গানে মানুষের কথা বলেন, সমাজের অসংগতির কথা বলেন। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা অন্যায়, দুর্নীতি, বৈষম্য, ধর্মান্ধতার ওপর আঘাত হানেন তার প্রতিবাদী কথায়, সুরে। শুধু অসংগতির কথা বলেই ক্ষান্ত হন না তিনি, সচেতনতা সৃষ্টিতে কড়া নাড়েন, গণমানুষের মনের দুয়ারে, সুন্দর জীবনের পথও নির্দেশ করেন গানের শক্তিতে।

বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছেন স্বভাবকবি ও গায়ক অর্জুন বিশ্বাস। পারিবারিক সূত্রেই তর সংগীতে হাতেখড়ি। বাবা ছিলেন শৌখিন যাত্রাদলের প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক। তার অগ্রজ নকুল কুমার বিশ্বাসও এই উপমহাদেশের একজন সুপরিচিত সংগীত ব্যক্তিত্ব। প্রফেশনাল যাত্রাদলের হাফপ্যান্ট পরা হারমোনিয়াম মাস্টার হিসেবে অর্জুন বিশ্বাস নিজেকে প্রকাশ করা শুরু করেন সংগীত অঙ্গনে। জীবনের বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে তার মিডিয়াজগতে পদার্পণ। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। জীবনে হারিয়েছেন অনেক কিছু, তবে অর্জনের তালিকাও নেহাত কম নয়। দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার মতে, মানুষের ভালোবাসাই জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।  

তার সংগীত ও ক্ষুরধার গানের কবিতা নিয়ে মূল্যায়ন করেছেন দেশের বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, সংগীত ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন গুণীজন। কবি শামসুর রাহমান অর্জুন বিশ্বাসের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তোমার লেখায় ভাবাবেগ আছে বেশ, প্রতিবাদের সুরও আছে ভাষায়।’ প্রখ্যাত সাহিত্যিক শওকত ওসমান তাকে আশীর্বাদ জানিয়েছেন এভাবে— ‘অনুজোষ্ম শ্রী অর্জুন বিশ্বাসকে—/ তুলে নাও তোমার গাণ্ডিব একবার/ বড়ো এই জন্মভূমি রক্ত আর হাহা-শ্বাস ভরা/ ভীষ্মের ক্ষত্রিয়-নাশ ভূমিকায়/ ক্ষৌরিত চিকুরহীন করো এই ধরা।’ ড. আনিসুজ্জামান অর্জুন বিশ্বাসকে এভাবে মূল্যায়ন করেন, ‘তোমার কবিতায় ভাবের বাস্তবতা— প্রবলতা, দ্বন্দ্বহীন ছন্দের মাধুর্য আছে। ভাষায় তীক্ষ তিরের ফলক আছে—যা মানুষের বিবেক-সমর্থিত মনে বেঁধে।...মহাভারতের অর্জুনের মতো হও। শুভকামনা তোমার জন্য।’ এছাড়াও ড. হুমায়ুন আজাদ, ড. ওয়াকিল আহমেদ, অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস, গীতিকবি রফিকউজ্জামানসহ বাংলাদেশের প্রথিতযশা লেখক-কবি-অধ্যাপকরা তার গানের কবিতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন।

গানের এমন কোনো আঙ্গিক নেই, যেখানে অর্জুন বিশ্বাস স্পর্শ করেননি। একটি সাক্ষাত্কারের মাধ্যমে জানা যায়, নজরুলসংগীত দিয়ে তার গানের হাতেখড়ি। তবে প্রথম জীবনে লোকগান, বৈঠকি গানও করেছেন। এরপর আধুনিক গান, রবীন্দ্রসংগীত নজরুলসংগীত এবং গণসংগীত নিয়মিত চর্চা করেছেন। সংগীত কলেজে উচ্চাঙ্গসংগীত, নজরুলসংগীত ছিল তার পড়াশোনার বিষয়। ফলে নজরুলসংগীতের প্রতি আসক্তি ছিল বেশি। বাংলাদেশ বেতারেও নজরুলসংগীতশিল্পী হিসেবেই তালিকাভুক্ত তিনি। তবে ‘ইত্যাদি’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে নিজের লেখা গান দিয়েই শিল্পীজীবনে তার প্রতিষ্ঠা। বর্তমানে নিজের লেখা, সুর করা, গান নিয়ে নিমগ্নচিত্তে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। গানের যত ধারা বা আঙ্গিক আছে—জীবনমুখী, গণসংগীত, আধুনিক, দেশাত্মবোধক, রাগপ্রধান, পল্লি আঙ্গিক, বাউল আঙ্গিক, ভজন, কীর্তন, শ্যামাসংগীত, আধ্যাত্মিক, কাওয়ালি, রম্যসহ বিচিত্র স্বাদের গান লেখায় তিনি সিদ্ধহস্ত হলেও জীবনমুখী-গণসংগীতেই নিজেকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন আলাদাভাবে।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

ইত্তেফাক/এএইচপি