আজ দিবাগত রাত্রে সমগ্র দেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ পালন করিবেন পবিত্র শবেবরাত। মহিমান্বিত এই রজনীর মর্যাদা ও তাত্পর্য অপরিসীম। হিজরি সালের পবিত্র শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রিকে বলা হয় শবেবরাত। ফার্সি ‘শব’ শব্দের অর্থ ‘রাত্রি’ এবং ‘বরাত’ অর্থ ‘মুক্তি’ বা ‘নিষ্কৃতি’। এই জন্য ইহাকে মুক্তির রজনিও বলা হয়। এই রাত্রে আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য গুনাহগার বান্দার পাপ ক্ষমা করিয়া দেন। এই জন্য মুসলমানগণ এই রাত্রি অধিকতর ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে উদ্যাপন করিয়া থাকেন। হাদিস শরিফে এই রাত্রিকে ‘লাইলাতুন মিন নিসফি শাবান’ বা শাবানের মধ্যরাত্রি হিসাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। তবে মুসলিম উম্মাহর নিকট এই রাত্রি শবেবরাত বা লাইলাতুল বরাত হিসাবে অধিক প্রসিদ্ধ ও পরিচিত।
মুসলিম তাহজিব-তামাদ্দুন বা সংস্কৃতিতে যেই সকল দিবস ও রজনি বিখ্যাত, তাহার মধ্যে পাঁচটি রাত্রি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পাঁচটি রাত্রি হইল : দুই ঈদের রাত্রিদ্বয়, শবেমেরাজ, শবেবরাত ও শবেকদর। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘হা-মিম। শপথ, উজ্জ্বল কিতাবের। নিশ্চয় আমি তাহা নাজিল করিয়াছি এক বরকতময় রাত্রে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাহাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়’। (সুরা দুখান) কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, এখানে ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনি বলিয়া শাবান মাসের পূর্ণিমা রাত্রিকে বোঝানো হইয়াছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)। অন্যদিকে শবেবরাতের ফজিলত সম্পর্কে হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) যাহা বলিয়াছেন তাহার সারমর্ম হইল, একবার এই রাত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দীর্ঘ সেজদা করিলেন এবং নামাজ শেষে আমাকে লক্ষ্য করিয়া এই রাত্রি সম্পর্কে বলিলেন, ইহা হইল অর্ধশাবানের রাত্রি; এই রাত্রে আল্লাহ তাআলা তাহার বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করিয়া দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাহাদের অবস্থাতেই ছাড়িয়া দেন। (শুআবুল ইমান)। এই রাত্রে মহানবি (স.) মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে আসিয়া মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করিতেন। এই রাত্রে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চাইতেও অধিকসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করিয়া দেন (তিরমিজি)। আর তত্কালে বনি কালবের ভেড়ার সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক।
এই রাত্রে করণীয় সম্পর্কে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) বলিয়াছেন, ‘যখন শাবানের মধ্য দিবস আসিবে, তখন তোমরা রাত্রে নফল ইবাদত করিবে ও দিনে রোজা পালন করিবে’ (ইবনে মাজাহ)। আমরা জানি, ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হইল নামাজ; তাই নফল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হইল নফল নামাজ। আবার ইবাদতের জন্য দিন অপেক্ষা রাত্রি শ্রেয়তর। রাসুলুল্লাহ (স.) রমজান মাসের পর রজব ও শাবান মাসে বেশি বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করিতেন। শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি, কখনো আবার তাহার চাইতেও অধিক নফল রোজা রাখিতেন। এই জন্য শবেবরাতে আমাদের করণীয় হইল : বেশি বেশি নফল নামাজ (তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলিল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, ছলাতুত তাসবিহ, ছলাতুল হাজাত, ছলাতুশ শোকর প্রভৃতি) আদায় করা, নামাজে কিরাআত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা, পরের দিন নফল রোজা রাখা; কোরআন শরিফ (সুরা দুখান ও অন্যান্য ফজিলতের সুরাসমূহ) তিলাওয়াত করা, বেশি বেশি দরুদ শরিফ পড়া, অধিক পরিমাণে তাওবা-ইস্তিগফার করা; দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আজকার ও কবর জিয়ারত করা ইত্যাদি। তবে এই রাত্রে আতশবাজি, পটকা ফোটানো, ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়া বেহুদা ঘোরাফেরা, অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দ-উল্লাস, অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা, অন্য কাহারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো, হালুয়া-রুটি বা খাওয়াদাওয়ার পিছনে অধিক সময় নষ্ট করিয়া ইবাদত হইতে গাফিল থাকা ইত্যাদি গর্হিত কাজ। মহান আল্লাহতালা এই বরকতময় রজনিতে আমাদের অধিক পরিমাণে নেক আমল করিবার তৌফিক দান করুন। আমিন।