চাঁদে সবসময় কোনো রাষ্ট্রের উদ্যোগে নভোযান পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্র, তা যত ছোট কিংবা বড়ই হোক— তার শক্তি ও সামর্থ্য বিশাল ও বিপুল হয়ে থাকে। কিন্তু কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান যদি চাঁদে নভোযান পাঠায়, তাহলে ব্যাপারটা বিস্ময়কর বটে। এমনই বিস্ময়কর কাণ্ড করেছে যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনভিত্তিক ইনটুইটিভ মেশিনের ‘ওডিসিয়াস’। বলা যায়, ১৯৭২ সালের অ্যাপোলো অভিযানের পর চাঁদের বুকে যাওয়া প্রথম কোনো মার্কিন মহাকাশ যান, তাও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে। মনুষ্যবিহীন ‘ওডিসিয়াস’ নেমেছে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে। ওডিসিয়াসে করে ছয়টি বৈজ্ঞানিক যন্ত্র পাঠিয়েছে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা। অবতরণের গত শুক্রবার সংস্থাটির প্রধান বিল নেলসন এই ‘সাফল্যের’ জন্য অভিনন্দন জানাতে দেরি করেননি। নেলসন বলেন, ‘আজ মানবতার ইতিহাসে প্রথম বার, একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি, একটি আমেরিকান কোম্পানি এমন অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিল।’ ওডিসিয়াস বাংলাদেশ সময় শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে নামে। কার্যকারিতার দিক থেকে এটি একটি রোবটের মতোই। মহাকাশ যানটির গন্তব্য নির্ধারণ করা হয়েছিল চাঁদের মালাপের্ট নামের একটি পাহাড়ি এলাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। এই পার্বত্য এলাকার উচ্চতা প্রায় ৫ কিলোমিটার। জায়গাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চাঁদের এত দক্ষিণে এখন পর্যন্ত আর কোনো মহাকাশ যান যায়নি। বিবিসি জানিয়েছে, নাসার সরঞ্জামাদি ছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি জিনিস দিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওডিসিয়াসের সঙ্গে। এর মধ্যে রয়েছে এমব্রি-রিডল অ্যারোনটিক্যাল ইউনিভার্সিটির পাঠানো একটি ক্যামেরা সিস্টেম। চাঁদের মাটির থেকে যানটি ৩০ মিটার উঁচুতে থাকার সময়ই এটি স্থাপন হওয়ার কথা। ক্যামেরা সিস্টেমটি ডিজাইন করা হয়েছে রোবটটির সেলফি তোলার জন্য। আমেরিকান শিল্পী জেফ কুনস ল্যান্ডারের পাশে একটি বাক্স জুড়ে দিয়েছেন। বাক্সে স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি ১২৫টি ছোট বল রয়েছে। এক মাসে চাঁদের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতীক এই বলগুলো।
ইতিপূর্বে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নভোযান পাঠিয়েছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো। কিছুদিন আগে চীনের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, খুব শিগিগরই চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে মহাকাশযান পাঠাবেন তারা। সেই চন্দ্রাভিযানের নাম হবে ‘চাংই-৭’। ২০২০ সালে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং জার্মান এরোস্পেস সেন্টারের যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত সোফিয়া টেলিস্কোপ চাঁদের দক্ষিণ মেরু সম্পর্কে জানায় যে, এই অংশে পানি এবং অন্যান্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ থাকতে পারে। মনে রাখতে হবে, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সূর্যের আলো পড়ে না। এই অংশটি চির আঁধারে নিমজ্জিত। বিজ্ঞানীদের মতে, এই অংশে প্রাণের অস্তিত্বের জন্য উপযোগী সম্পদ পাওয়া যেতে পারে।
তবে দক্ষিণ মেরুর পদে পদে রয়েছে বিপদ এবং প্রতিকূলতার হাতছানি। অংশটি সম্পূর্ণরূপে বরফে মোড়া। এখানে বিশাল বিশাল কিছু খাদ রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খাদের বিস্তার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। আলো কম থাকায় উন্নত প্রযুক্তি সংবলিত মহাকাশযানও এই অংশে এসে কাবু হয়।
এদিকে গত ১৯ জানুয়ারি ‘জাপান এরোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি’ ঘোষণা করেছে যে, তাদের ‘স্লিম’ (স্মার্ট ল্যান্ডার ফর ইনভেস্টিগেটিং মুন) স্পেসক্রাফট চাঁদের মাটিতে সফলভাবে অবতরণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতের পরে জাপান পঞ্চম দেশ, যারা চাঁদের মাটি স্পর্শ করল। জাপানের চন্দ্রযানের অবতরণের পরে মিশন কন্ট্রোল রুমে খবর আসে, সব ঠিক আছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখেন, কোনো এক অজানা কারণে চন্দ্রযানের
গায়ে থাকা সৌর প্যানেলগুলো কাজ করছে না। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, সৌর প্যানেল কাজ না করার অর্থ, কিছুক্ষণের মধ্যে স্লিম-এর চার্জ ফুরিয়ে যাবে। অকেজো হয়ে পড়বে। পরিস্থিতি সামলাতে অভিযানের সঙ্গে যুক্ত থাকা ইঞ্জিনিয়াররা ল্যান্ডারটিকে ঘুম পাড়িয়ে দেন। অর্থাত্ স্লিপ মোডে পাঠিয়ে দেন। ততক্ষণে তারা এই বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে থাকেন। যে রহস্যের সমাধান হয়েছে সম্প্রতি। স্লিম ও অবতরণস্থলের ছবি তুলে এলইভি-১ মারফত মিশন কন্ট্রোল রুমে পাঠায়। সেই ছবি পরীক্ষা করে দেখা যায়, স্লিম স্পেসক্রাফট মাটিতে উলটো হয়ে পড়ে। সৌর প্যানেলগুলো পশ্চিম দিকে এমন ভাবে হেলে রয়েছে যে চার্জ হওয়ার উপায় নেই। স্লিমকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার আগে চন্দ্রপৃষ্ঠের বেশ কিছু ছবি তুলিয়ে নিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাতে বোঝা গিয়েছে, একটি ঢালের ওপর দাঁড়িয়ে স্লিম। আশপাশে অনেক পাথর। চাঁদের নিরক্ষীয় অঞ্চল শিওলি গহ্বরে অবতরণ করেছে স্লিম। বিজ্ঞানীদের আশা আকাশে সূর্যের অবস্থান পরিবর্তন হলে, চাঁদে দিন শুরু হলে (পৃথিবীর হিসেবে ১৪ দিন) যথেষ্ট সূর্যালোক পেয়ে যাবে ঐ প্যানেলগুলো। তখন স্লিম-এর চার্জ হবে। অভিযান হয়তো ব্যর্থ হবে না।
এটা গেল চাঁদের দক্ষিণ দিকের যত অভিযান। এর আগে চাঁদের ‘অন্ধকার দিকে’র রহস্যভেদ করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন বিজ্ঞানীরা। উলটো পিঠে কী আছে—কিছুদিন আগে তার ছবি প্রকাশ করেছে নাসা। নাসা লিখেছে, ‘এই হলো চাঁদের সেই মুখ, যা আমরা পৃথিবী থেকে দেখতে পাই না।’ তবে একে চাঁদের ‘অন্ধকার দিক’ বলে অভিহিত করা সর্বার্থে ভুল। কারণ সূর্যের আলো যতখানি চাঁদের চেনা প্রান্তে পড়ে, ততটাই আলোকিত করে চাঁদের না-দেখা অংশটিকেও। চাঁদের এই প্রান্তটি দেখতে কেমন, তার বিস্তারিত বর্ণনাও দিয়েছে নাসা। তারা জানিয়েছে, চাঁদের এই প্রান্তের জমি অনেক বেশি অমসৃণ এবং কঠিন। কিন্তু এই প্রান্তে ‘মারিয়া’র পরিমাণও অনেক কম। ‘মারিয়া’ কী জিনিস? ‘মারিয়া’ হলো চন্দ্রপৃষ্ঠে থাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশালাকৃতি সামান্য নিচু সমতল ভূমি— যা চাঁদের আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর লাভা থেকে তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। তবে এই মারিয়াকে এককালে সমুদ্র ভেবে ভুল করেছিলেন মহাকাশচারীরা। তাদের সেই ভুল থেকেই এই জায়গাগুলোর নাম দেওয়া হয় ‘মারিয়া’। শব্দটি ল্যাটিন, যার অর্থ ‘সমুদ্র’। এই ‘মারিয়া’ চাঁদের দৃশ্যমান প্রান্তের ১৬ শতাংশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এই এলাকাগুলোর মাটিতে লোহার উপস্থিতি বেশি থাকে বলে এখানে সূর্যের আলো প্রতিফলন করে কম। ফলে এগুলোকে চাঁদের গায়ে কালচে ছোপের মতো মনে হয়। একেই আমরা বলি চাঁদের ‘কলঙ্ক’।
চাঁদের অ-দেখা ‘কলঙ্ক’ মুখে ক্রেটার বা ছোটবড় গর্তের সংখ্যা কম নয়। চাঁদের দৃশ্যমান প্রান্তের মতোই অজস্র ক্রেটার ছড়িয়ে রয়েছে চাঁদের অন্য পৃষ্ঠ জুড়ে। চাঁদের কলঙ্ক জয়ের চেষ্টার শেষ নেই। বড় সম্ভাবনার বিপদসংকুল জায়গা। মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় বলতে হয়— ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে/ দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?’
লেখকঃ শিক্ষক, সাংবাদিক