বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১
The Daily Ittefaq

অকল্পনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে গাজার শিশুরা

আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৫:৩০

পাঁচ মাস পার হতে চললেও থামানো যায়নি গাজা যুদ্ধ। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলমান সংঘাতে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা মৃত্যুপরীতে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধের দামামায় আশ্রয়ের সন্ধানে দক্ষিণাঞ্চলে ছুটে গেলেও নিস্তার মিলছে না গাজাবাসীর। কারণ, রাফাহ অঞ্চল জুড়ে বড় ধরনের হামলা চালানোর হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে ইসরাইলি বাহিনী।

বলা বাহুল্য, মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে রাফাহ শহরের জনসংখ্যা ৩ লাখ থেকে বেড়ে ১৪ লাখে দাঁড়িয়েছে! হাজারো শিশুকে বুকে জড়িয়ে হতাশ পরিবারগুলো মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। সবার যেন একটাই চাওয়া, ভয়ংকর সহিংসতা থেকে আশ্রয় ও মুক্তিলাভ। রাফাহে আশ্রয় নেওয়া ভুক্তভোগী গাজাবাসী চরম বিপদের প্রহর গুনছে। তাদের সময় কাটছে চরম ভয় আর উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায়।  দুঃখজনক বিষয় হলো, আশ্রয়ের সন্ধানে গাজা থেকে পালিয়ে আসা মানুষের আর যাওয়ার জায়গা নেই। সহজ করে বললে, গাজাবাসীকে অন্যত্র ঠেলে দেওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই।

উল্লেখ করার বিষয়, মিশরের সীমান্তঘেঁষা রাফাহের আয়তন মাত্র ২৫ বর্গমাইল। এই ছোট্ট শহরই এখন প্রায় ১৫ লাখ মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়ে উঠেছে। ফলে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুসারে রাফাহ শহর এখন নিউ ইয়র্ক সিটির দ্বিগুণ এবং ওয়াশিংটন ডিসির চার গুণেরও বেশি। আরো দুঃখজনক কথা, আমেরিকান শহরগুলোর মতো উঁচু উঁচু ভবন বা টাউনহোমে বসবাস করার সুযোগ নেই বাসিন্দাদের। বরং আশ্রিত হাসপাতাল ও স্কুলে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে তাদের।

উদ্বেগজনক সংবাদ, ৬ লাখ ১০ হাজারেরও বেশি শিশু আটকা পড়েছে রাফাহে। এই বিশালসংখ্যক শিশু বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। আশ্রয় গ্রহণকারীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি সমস্যা পোহাতে হচ্ছে শিশুদের। সহ্য করতে হচ্ছে অকল্পনীয় দুর্ভোগ। ঠান্ডা ও শীতের ভেজা আবহাওয়ায় শিশুরা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। রাস্তার পাশে, তাঁবু ও ত্রিপলের (পলিথিনের ছাউনি বিশেষ) নিচে দিন কাটানো শিশুদের অবস্থা কী হতে পারে, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?

গাজার ছোট্ট অঞ্চল রাফাহ ইতিমধ্যে ব্যাপক দুর্ভোগের শিকারে পরিণত হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষের হুদয়বিদারক কষ্ট ও ব্যথা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শোনা যাচ্ছে, রাফাহ শহর ইসরাইলি আক্রমণের মুখে পড়বে। আগেই বলা হয়েছে, এই অঞ্চল এখন জনসংখ্যার অতিরিক্ত ঘনত্বের কারণে হিমশিম খাচ্ছে। তাছাড়া নিরাপদ স্থান দূরের কথা, তিল ধারণের অবস্থাও নেই এই শহরে। ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতে রাফাহে সামরিক শক্তির প্রয়োগ কী পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি বয়ে আনবে, তা সহজেই অনুমেয়।

রাফাহে সামরিক অভিযান চালানো হলে কী ধরনের ধ্বংসলীলার অবতারণা ঘটবে, তা আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ করেছি। গাজার অন্যান্য অংশে চালানো একেকটি ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী আমরা। গত চার মাসে গাজায় নিহত হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। মর্মান্তিক খবর হলো, নিহতদের ৭০ শতাংশই শিশু ও নারী।

রাফাহে যদি সত্যি সত্যিই হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী, তাহলে মুত্যু ও আহতের সংখ্যা বেড়ে যাবে ব্যাপক পরিমাণে। মাত্র ২৫ বর্গমাইলের ছোট্ট এক অঞ্চলের লাখ ১৫ মানুষের ওপর বোমা হামলা চালানো হলে কী ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের অবতরাণা ঘটবে, তা ভাবলেই শিহরিত হতে হয়! উদ্বেগের আরো কারণ, হামলা থেকে যারা বেঁচে যাবে, তাদের কপালে জুটবে আরো বড় দুর্ভোগ। অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরবে হাজার হাজার মানুষ। তাছাড়া বেসামরিক জনগোষ্ঠীর কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর কাজেও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটবে। সব মিলিয়ে কষ্ট-দুর্ভোগ মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।

ইউনিসেফের যেসব কর্মী এই যুদ্ধে মানবিক সহায়তা প্রদানে কাজ করছেন, তাদের সবাই এই নিষ্ঠুর ভয়াবহতার সাক্ষী। কোনো দ্বিমত নেই, পক্ষগুলো স্পষ্টত ‘শিশু অধিকার’ লঙ্ঘন করে চলেছে। শিশুদের হত্যার পাশাপাশি তাদের পঙ্গু করে দেওয়া ও অপহরণের মতো বহু ঘটনা ঘটেছে। স্কুল ও হাসপাতালে যেসব হামলা চালানো হয়েছে, তাতে মারা পড়েছে বহু শিশু। এতটুকুতেই থেমে থাকেনি শিশুদের দুর্ভোগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুদের প্রতি মানবিক সহায়তা পাঠানো কঠিন হতে দেখা গেছে।

আহত শিশুদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যাদের শরীর পুড়ে গেছে মারাত্মভাবে। অঙ্গচ্ছেদের শিকারও হয়েছে অনেকে। শরীরে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে বহু শিশু। যারা কাছ থেকে দেখেছেন, কেবল তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন, কী দুঃসহ পরিস্থিতিতে রয়েছে গাজার শিশুরা।

ভুলে গেলে চলবে না, হাতে গোনা হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র, বাজার (মার্কেট) ও পানির ব্যবস্থা টিকে আছে রাফাহ শহরে। শিশুদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য এগুলো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এই ক্ষেত্রগুলোও যদি বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে হামলা থেকে বেঁচে ফেরা মানুষকে বাকি জীবন ক্ষুধা ও রোগের সঙ্গে লড়াই করেই টিকে থাকতে হবে। আর সেক্ষেত্রে শিশুদের ভোগ করতে হবে অবর্ণনীয় কষ্ট-দুর্ভোগ।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ইতিমধ্যে গাজার পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের অন্তত ৯০ শতাংশ এক বা একাধিক সংক্রামক রোগে ভুগছে। ৭০ শতাংশ শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। এই কঠিন অবস্থায় নতুন করে হামলার ঘটনা ঘটলে শিশুদের অবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভাবিয়ে তুলছে।

বড় ধরনের সামরিক অভিযানের খবরে রাফাহ থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে তাদের? গাজার বেশির ভাগ অংশ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। ফলে এই অঞ্চলের বেসামরিক বাসিন্দাদের জোরপূর্বক অন্যত্র বাস্তুচ্যুত করা ঠিক হবে না আদৌ। অনেকে বলছেন, গাজার দক্ষিণ উপকূলের ফিলিস্তিনি শহর আল-মাওয়াসিতে তাদের পাঠানো হতে পারে। এটা কি কোনোভাবে যুক্তিসংগত হতে পারে?  মনে রাখা দরকার, আল-মাওয়াসি শহর সমুদ্রসৈকতের খুব কাছের একটি এলাকা। খুবই সংকীর্ণ শহর এটা। এখানে পর্যাপ্ত টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। জীবন ধারণে প্রয়োজনীয় পানিসহ মৌলিক অবকাঠামোর মারাত্মক ঘাটতির পাশাপাশি নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত এই অঞ্চল। অর্থাত্, এই অঞ্চলে রাফাহের জনগণকে ঠেলে দেওয়া কতটা ন্যায়সংগত হবে, সে বিষয়ে চিন্তার অবকাশ রয়েছে।

গাজা যুদ্ধের কারণে রাফাহ শহরের বেশির ভাগ শিশু ইতিমধ্যে একাধিকবার বাস্তুচ্যুতের শিকার হয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। এক জরিপে জানা গেছে, গাজার অন্তত ১৭ হাজার শিশু বর্তমানে সঙ্গীহীন অবস্থায় দিন যাপন করছে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার শিশু। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রাফাহে নতুন করে হামলা চালানো হলে তা হবে শিশুদের অস্তিত্বের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার শামিল, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

স্পষ্ট কথা, রাফাহ এবং এর আশপাশের এলাকায় সামরিক হামলা চালানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবে। একই সঙ্গে হামাসের হাতে জিম্মি ইসরাইলিদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে দ্রুততার ভিত্তিতে। পক্ষগুলো যদি এই আহ্বানে কর্ণপাত না করে, তাহলে বেসামরিক মানুষ নিহতের পাশাপাশি হাজারো নিরপরাধ শিশু মারা পড়বে বেঘোরে। আর সেক্ষেত্রে শিশু মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হবে পক্ষগুলোকেই।

পক্ষগুলোর প্রতি আমদের উদাত্ত আহ্বান, অবিলম্বে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। স্থায়ী মানবিক যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। আক্রান্ত মানুষের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করাটাও অত্যন্ত জরুরি। মানবিক কর্মীদের চলাচলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য আমি কর্তৃপক্ষকে দৃঢ়ভাবে অনুরোধ জানাই। পরিশেষে বলতে হয়, ধ্বংস কিংবা বেসামরিক মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে শান্তি বা নিরাপত্তা আসবে না কখনোই।

লেখক:ই উনিসেফের নির্বাহী পরিচালক

সিএনএন থেকে অনুবাদ: সুমৃত খান সুজন

ইত্তেফাক/এমএএম