ঢাকা মহানগরীর খ্যাতি সুদীর্ঘকালের। এ খ্যাতি যতটা না রাজধানী হওয়ার কারণে তার চেয়ে বড় খ্যাতি ছিল অতীতের বহু প্রসিদ্ধ শিল্পপণ্য, বিস্তৃত ব্যবসায়-বাণিজ্য ও প্রাচুর্যের কারণে। প্রবাদ রয়েছে, মসজিদের শহর ঢাকা নগর। এ নগরে আদিকাল থেকে তুলা চাষ হওয়ায় এখানকার আদিবাসীদের প্রধান পেশা ছিল মসলিন বস্ত্র তৈরি। নবাব শায়েস্তা খাঁর আমলে টমাস বাউরি নামক একজন পরিব্রাজক ঢাকা সফর করে ঢাকা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ঢাকা শহরের গুরুত্ব এর চমত্কার দালানকোঠা এবং এর বিচিত্র বাসিন্দাদের জন্য।’ জনশ্রুতি আছে, ঢাকা শহরে ৫২টি বাজার ও ৫৩টি রাস্তা থাকার কারণে এ শহরটিকে ৫২ বাজার ৫৩ গলি নামে একসময় অভিহিত করা হতো। সেই সময় ঢাকা শহরে বসবাসরত জনসংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ২ কোটি।
মানুষের ভারে নুয়ে পড়ছে অপরিকল্পিত এই ঢাকা নগরী। কর্মসংস্থান, ভাগ্যান্বেষণ, লেখাপড়া চিকিৎসা কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে দেনদরবার করার জন্য গ্রাম থেকে এই নগরীতে স্রোতের মতো মানুষ প্রতিদিন ছুটে আসছে। মানুষের ভিড় আর অসহনীয় যানজটের কারণে জীবনের গতি যেন থেমে যাচ্ছে। প্রশাসনিক সব কার্যক্রম ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় মানুষ ছুটে আসে ঢাকা নগরীতে। সরকার যানজট কমানোর জন্য মেট্রোরেল, ফুটওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ যাতায়াতের সুবিধার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সুষ্ঠু এবং যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে যানজট না কমে উলটো আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এ মহানগরী শুধু আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকেই বিপর্যস্ত করছে না, অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাড়িয়ে দিয়েছে শ্রেণিবৈষম্য। মাটি, পানি ও পরিবেশ দূষণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যসংকট। এই সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার নারী ও শিশু। বিশ্বে দূষিত শহরের তালিকায় এক নম্বরে উঠে এসেছে ঢাকা মহানগরী (০৪.৩.২৪ যুগান্তর), ২য় স্থানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা এবং ৩য় স্থানে ভিয়েতনামের হ্যানয় শহর।
ঢাকার বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে আইকিউএয়ার পরামর্শ দিয়েছে ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করার পাশাপাশি ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রেখে মানুষ কতক্ষণ বাঁচতে পারে? দম বন্ধ হয়ে এমনিতেই তো একসময় মারা যাবে। এ মহানগরীর রাস্তাঘাট অপরিচ্ছন্ন, নোংরা দুর্গন্ধময় হওয়ায় এখানকার পরিবেশও দূষিত হয়ে গেছে। মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে। এখানে রাস্তাঘাটে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে অবাধে। বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে হাজার হাজার অপরিকল্পিত ভবন। নগরীতে বিভিন্নভাবে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়—কখনো সিলিন্ডার ব্রাস্ট হয়ে, কখনো গ্যাসলাইন ফেটে, কখনো সুয়ারেজ লাইন, আবার কখনো পানির লাইন, পানির ট্যাংক ব্রাস্ট হয়ে। ঢাকা শহরের ভিআইপি সড়কগুলো ছাড়া এমন কোনো সড়ক বা অলিগলি নেই, যেখানে সারা বছরই রাস্তা বন্ধ করে ইট, বালু-সুরকি ইত্যাদি দিয়ে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে না। অপরিকল্পিত ভবন তৈরি হওয়ায় রাস্তাঘাটও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনার সময় ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্সসহ উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে বাধার সম্মুখীন হন। সামান্য বৃষ্টিতেই নগরী ডুবে যায়। সুয়ারেজ লাইনগুলো উপচে পড়ে ময়লা দুর্গন্ধে ভরে যায়। এসব ময়লার ওপর দিয়েই বাধ্য হয়ে আমাদের চলাচল করতে হয়। রাস্তার পাশে ম্যানহোলের ঢাকনা না থাকায় অনেক সময় মানুষ এই ম্যানহোলের ভেতরে পড়েও প্রাণ হারায়। নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে ইট পড়েও কত অপমৃত্যু ঘটেছে তার হিসাব নেই।
আসলে এসব অপমৃত্যুর যদি সঠিক তদন্ত এবং সময়মতো বিচার এবং যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা হতো, তাহলে অপঘাতে মৃত্যুসহ জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমে যেত, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। সুশাসনের অভাবেই এসব প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে এমন কোনো খাত নেই যেখানে অনিয়ম আর দুর্নীতির কালো থাবা নেই; অনিয়ম, শৃঙ্খলাবহির্ভূত কাজ হচ্ছে না। মানুষের নৈতিকতা মানবিক মূল্যবোধ, ভদ্রতা, সৌজন্যতা, আন্তরিকতা, শিষ্টাচার সবকিছুই অর্থলিপ্সার কাছে হারিয়ে যাচ্ছে। আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। আমাদের সমাজে অপরাধপ্রবণতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। অপরাধীদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা যেত, তাহলে অপরাধপ্রবণতা এতটা বাড়ত না। আইনকেও বুড়ো আঙুল দেখাত না। আমাদের কোথাও কোনো জবাবদিহি নেই। যার যা ইচ্ছে করে যাচ্ছে। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনে দুজন মেয়র, কমিশনার, ওয়ার্ড কমিশনার থাকার পরেও জবাবদিহি না থাকার কারণে সুস্থভাবে চলাফেরা করার কোনো সুযোগ নেই। অথচ রাজশাহী শহরের উন্নয়ন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চোখে পড়ার মতো। আসলে আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব। আমাদের সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেধা, দক্ষতা বা অভিজ্ঞতার কোনো মূল্যায়ন হয় না। ফলে অদক্ষ ব্যক্তিরা ওপরমহলে তোষামোদি করে টিকে থাকার চেষ্টা করে। যার যে দায়িত্ব তা সঠিকভাবে পালন করছেন না। টাকা দিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করার চেষ্টা করা হয়। অনিয়ম আর দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে। এখানে অনিয়মটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা রোড অ্যান্ড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত বছর সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মৃত্যু হয়েছে তার ২৯ শতাংশ ঢাকা নগরীতে। যখন কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন তাত্ক্ষণিকভাবে হইচই পড়ে যায়। গণমাধ্যমগুলো গরম গরম খবর সরবরাহ করে, তারপর এই ঘটনা নিয়ে পরবর্তী সময়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু যে পরিবারের ক্ষতি হয় সে পরিবারটি সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর অনেক মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। এই মৃত্যুর বেশির ভাগ সংঘটিত হয় ঢাকায়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের এক জরিপে জানা যায়, গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে ৭০৯ জন। প্রশাসনের অবহেলার কারণে এসব অপ্রত্যাশিত মৃত্যুকে কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। আমরা যে যেখানে আছি সেখানে যদি আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নীতি-নৈতিকতা এবং বিবেক দিয়ে সুষ্ঠুভাবে পালন করতাম, তাহলে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হতো না। দুর্ঘটনা ঘটার পরে বর্তমানে যেভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে সেভাবে যদি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, ভেজালকারীসহ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সব সময়ই তৎপর হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো, তাহলে নগরীর সাধারণ মানুষগুলোকে এত ভোগান্তি সম্মুখীন হতে হতো না। সর্বক্ষেত্রে নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো। আমরা নগরবাসী সুস্থ-সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই। অস্বাস্থ্যকর দমবন্ধ পরিবেশে নিরাপত্তাহীনতার মধ্য থেকে আমাদের রক্ষা করুন।
লেখক: অর্থনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক
মহাব্যবস্থাপক (অব.), বিসিক (BSCIC)