শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

বৃহৎ পরিসরে পরিকল্পনা করতে হয়

আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ০৪:২১

আমরা প্রায়শই ‘আরবান প্ল্যানিং অ্যান্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট’ অর্থাৎ  ‘নগর পরিকল্পনা ও নগর উন্নয়ন’ বিষয় দুটিকে একই অর্থে ব্যবহার করে থাকি। আসলে এটা মোটেও ঠিক নয়। কারণ, আরবান প্ল্যানিং এবং আরবান ডেভেলপমেন্টের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেখানে শহরের কোথাও রাস্তা, বাড়িঘর নির্মাণ করা হলে কেউ যদি বলেন এটা আরবান প্ল্যানিং করে করা হয়েছে, তাহলে ঠিক হবে না। কারণ, এটা ব্যক্তি বা মালিকের ইচ্ছায় বা স্বার্থে হয়েছে নাকি বৃহত্তর স্বার্থে হয়েছে তা আমরা জানি না। ব্যক্তির ইচ্ছায় হলে তা তো নগর পরিকল্পনা নয়।

প্ল্যানিং বলতে আমরা বিভিন্ন স্টেজের বিভিন্ন স্কেলের কাজকে বুঝি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে অনেক বড় বিষয় নিয়ে প্ল্যানিং এবং অন্যটি হচ্ছে ছোট বা নির্দিষ্ট এলাকার জন্য প্ল্যানিং। আমরা কোন স্থানে একটি রাস্তা নির্মাণ করব কি করব না, সেটা যেমন জেনে নিতে হবে, তেমনি নির্মিত রাস্তাটি শহরের বৃহত্তর পরিসরে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে সেটাও জেনে নিতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের এখানে এখনো বৃহত্তর পরিসরে এসব প্ল্যানিং এখনো ঠিক মতো প্রণীত হচ্ছে না। প্ল্যানিংয়ের নামে যা হচ্ছে তাতে ক্ষুদ্র চিন্তা প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বৃহত্তর পরিমণ্ডলে প্ল্যানিং না হওয়ার কারণে প্রায়শই এসব প্ল্যানিং সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না।

আজ থেকে অনেক বছর আগে আমাদের শিক্ষক একটি উদাহরণ দিতেন। সেই একই উদাহরণ এখনো সমভাবে প্রযোজ্য। যেমন—রামপুরা এলাকায় যারা বসবাস করেন, তাদের যদি বলা হয়, রামপুরা এলাকায় কোনো বাজারের প্রয়োজন আছে কি না, তাহলে তারা নিশ্চিতভাবেই বলবেন, রামপুরায় বাজারের দরকার আছে। আবার হাতিরঝিল এলাকায় যারা বসবাস করেন, তাদের যদি একই প্রশ্ন করা হয়, তাহলে তারাও বলবেন তাদের জন্য বাজারের দরকার আছে। কিন্তু যে মানুষটি প্রতিদিন উত্তরা এলাকা থেকে মতিঝিলে আসা-যাওয়া করেন, তাকে যদি বলা হয়, রামপুরা এবং হাতিরঝিলে বাজারের প্রয়োজন আছে কি না। তাহলে তিনি নিশ্চয় বলবেন না যে এই দুটি এলাকায় বাজারের প্রয়োজন আছে। কারণ, বাজার বসলে সেখানে প্রতিদিনই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হবে। উত্তরাবাসীর চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। রামপুরা-হাতিরঝিল এবং উত্তরা এলাকায় বসবাসকারীগণ কিন্তু তাদের নিজ নিজ স্বার্থই দেখবেন। কাজেই এখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করলে তা এমনভাবে করতে হবে, যাতে সর্বনিম্ন ভোগান্তি এবং সর্বাধিক লোকের সর্বোচ্চ উপকার হয়। এজন্য বৃহত্তর পরিসরে প্ল্যানিং গ্রহণ করতে হয়।

আমাদের প্ল্যানিংগুলো যদি অংশীজনদের কথা মাথায় রেখে দীর্ঘ মেয়াদের কথা বিবেচনা করে গ্রহণ করা হতো, তাহলে তা আরো বেশি কার্যকর এবং ফলপ্রসূ হতে পারত। অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যানিং গ্রহণ করা হয় ঠিকই কিন্তু নানা কারণে সেগুলো বাস্তবায়িত হয় না। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা মাথায় রেখে ছোট ছোট উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে অসামঞ্জস্য বা সংঘর্ষ তৈরি হয়, তবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোকেই পালটে দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যানগুলো তৈরি করার পর তা মানতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আমাদের জন্য নেই। অর্থাৎ অবস্থা এমন, এসব প্ল্যান আমরা মানলে মানতেও পারি আবার উপেক্ষাও করতে পারি। এতে বিভিন্ন পর্যায়ের পরিকল্পনার মধ্যে এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়।

দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যানগুলো জনগণকে মানাতে হলে সরকারিভাবে গেজেট প্রকাশ করতে হবে। নিয়মিত সুপারভিশন করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান করার সময় এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, অন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত বা বাধাপ্রাপ্ত হবে কি না, যেমন সিটি করপোরেশন হয়তো ময়লা ফেলার জন্য স্থান নির্মাণ করবে। তখন তাদের দেখা উচিত সারা ঢাকার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে যে স্টাটেজিক প্ল্যান ও ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান করা হয়েছে তাতে কোথাও ময়লা ফেলার স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া আছে কি না। আবার ঢাকা ট্রান্সপোর্ট অথরিটি হয়তো একটি বাস টার্মিনাল নির্মাণের কথা চিন্তা করলেন। তাদের প্রথমেই ভাবতে হবে রাজউকের প্ল্যানে কোনো বাস টার্মিনাল স্থাপনের কথা বলা হয়েছে কি না। যদি বলা হয়ে থাকে, তাহলে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই নতুন বাস টার্মিনাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটা করা না হলে উভয় প্রতিষ্ঠানের কাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হবে।

এক সংস্থা হয়তো রাস্তা খনন করছে আর এক প্রতিষ্ঠান এসে রাস্তা ভরাট করছে। এভাবেই চলছে দিনের পর দিন। বিআইডব্লিউটিএ বা ওয়াসার কাজের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। ওয়াসা তাদের পানি কোথায় নিয়ে যাবে? ওয়াসা কোনো ড্রেনেজ সিস্টেম নির্মাণ করতে গেলে তাকে দেখতে হবে রাজধানীর কোন কোন এলাকায় আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার পরিকল্পনা যাও আছে তা মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তারাও সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না। গত বছর আগস্ট মাসে ঢাকা ডিটেইল্ড এড়িয়া প্ল্যান (ড্যাপ) চূড়ান্ত করা হলো। এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে ড্যাপকে রিভিউ করা হয়েছে। যারা মূল ড্যাপ প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের কারো সঙ্গে কোনো রকম পরামর্শ করা হয়নি। কোনো এক্সপার্ট সাজেশন গ্রহণ করা হয়নি। পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক ঘেরাটোপে ড্যাপ রিভিউ করা হয়েছে। যারা মূল ড্যাপ প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের মতামত গ্রহণ করা না হলে কীভাবে বোঝা যাবে ড্যাপে কোনো অসংগতি আছে কি না, কীভাবে পরিবর্তিত হলে তা সাধারণ মানুষের জন্য উপকারী হবে!

আমাদের মনে রাখতে হবে, যার কাজ তাকেই করা সাজে। অন্য কেউ সেই কাজ করতে গেলে সমস্যা না কমে বরং আরো বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কা থাকে। আমাদের প্রিয় রাজধানী শহর ঢাকা এখন মুমূর্ষু অবস্থায় আছে। প্রায়শই এক্সপার্টগণ যে সাজেশন দিচ্ছেন, তা বাদ দিয়ে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। একশ্রেণির মানুষ ঢাকা শহরকে নিয়ে বাণিজ্য করছেন। তাদের উদ্দেশ্য নগরবাসীর জন্য বাসযোগ্য সুন্দর নগরী উপহার দেওয়া নয়। নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়া।

আমরা যখন শহরের উন্নয়নের কথা চিন্তা করব, তখন আমাদের ভূমি ব্যবহার এবং পরিবহনসুবিধার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। শহরে নতুন স্থাপনা হলো কিন্তু ভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহার করা হলো, সেই উন্নয়নকে সঠিক এবং কার্যকর উন্নয়ন বলা যাবে না। উন্নয়ন অর্থ শুধু কিছু বড় বড় ভবন ব্যবস্থাপনা নির্মাণ করা নয়। উন্নয়ন অর্থ হচ্ছে শহরের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য কল্যাণ সাধন করা হয় এমন পরিবর্তন আনা। শহরে এমন কিছু স্থান থাকে, যেগুলো খুব বেশি ট্রাফিক অ্যাট্রাক্ট করে না। আবার কিছু ল্যান্ড ইউজ আছে, যা ট্রাফিক অ্যাটাক্ট করে। যেমন—মার্কেট, হাসপাতাল, নানা ধরনের বাজার, কমিউনিটি সেন্টার ইত্যাদি। এসব স্থাপনা এমন স্থানে তৈরি করতে হবে, যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পার্কিং প্লেস আছে। পার্কিং প্লেস ছাড়া এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হলে নিশ্চিতভাবেই যানজটের সৃষ্টি হবে। অথবা এমন সব স্থানে এসব স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে যেখানে এখনো যানজটের পরিমাণ কম বা সহনীয় পর্যায়ে আছে। এমনকি ব্যস্ত স্থানেও এসব স্থাপনা তৈরি করতে পারেন। সেই অবস্থায় স্থাপনাগুলো অভ্যন্তরে পার্কিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত স্থান সংরক্ষণ করতে হবে।

রাজধানী ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা একটি বিরাট সমস্যা। কিছুদিন আগে আমরা দেখলাম, বৃষ্টির পানি দীর্ঘ সময় আটকে থাকল। শহরের পানি কোন দিকে যাবে বা কীভাবে যাবে এটা বলার মতো কারিগরি দক্ষতা আমাদের নগর পরিকল্পনাবিদদের আছে। উল্লেখ্য, জলাবদ্ধতা এবং বন্যা এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বন্যা হচ্ছে বাইরে থেকে পানি এসে সবকিছু ভাসিয়ে নেওয়া। আর জলাবদ্ধতা হচ্ছে  দ্রুত সরে না গিয়ে স্থির হয়ে থাকা। অতএব, আমাদের এমনভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে এবং গৃহীত প্রকল্প যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু আমি মনে করি, আমাদের নিকট রাজধানীর জলাভূমিগুলো রক্ষা করাই মুক্তিযুদ্ধ। 

লেখক: অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা (ইউআরপি) বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

অনুলিখন: এম এ খালেক

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

 
unib