বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে আলোচিত বিষয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ইহা লইয়া একদিকে তৈরি হইয়াছে উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে উত্কণ্ঠা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হইতেছে, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ—ইহা লইয়া তর্কবিতর্ক চলিতেই থাকিবে। অবশ্য খোদ সাইন্স বা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কি এমন তর্কবিতর্ক এখনো চলিতেছে না? এমন প্রশ্ন থাকিবার পরও কি বিজ্ঞানের গতিপথ থমকাইয়া গিয়াছে? গত ২১ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্পর্কিত প্রথম বৈশ্বিক রেজুলেশন বা প্রস্তাব পাশ হইয়াছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটি উত্থাপন করে এবং ইহার প্রস্তাবক ছিল আরো ১২৩টি দেশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইহার নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা হয়তো রহিয়াছে; কিন্তু একটি নূতন প্রযুক্তির সকলই খারাপ—এমন মন-মানসিকতা পোষণ করা কোনোভাবেই কাম্য নহে।
গতকাল ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হইয়াছে যে, খোদ বাংলাদেশেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় যক্ষ্মা শনাক্তে সাফল্য আসিতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রক্রিয়ায় যক্ষ্মা নির্ণয় সফল হইয়াছে। বাংলাদেশে যদি রোবটের মাধ্যমে হার্টের চিকিত্সায় সফলতা পাওয়া যায়, তাহা হইলে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করিয়া অন্যান্য জটিল চিকিত্সার ক্ষেত্রেও কেন সফলতা পাওয়া যাইবে না? আমাদের দেশে রোবটের মাধ্যমে টেলিভিশনের খবর পাঠ, রেস্টুরেন্টে খাবার পরিবেশন—এমনকি গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কলকারখানায় শ্রমিক হিসাবে ইহার প্রচলন শুরু হইয়া গিয়াছে। ইহা একটি বিরাট পরিবর্তন নিঃসন্দেহে। ইহাতে চাকুরি-বাকুরির ক্ষেত্রে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হইতে পারে বলিয়া কেহ কেহ আশঙ্কা প্রকাশ করিলেও অনেকে আবার এই ব্যাপারে আশাবাদী। তাহারা বলিতেছেন, ইহাতে রোবটিক শিল্পে নূতন নূতন দক্ষতাসম্পন্ন লোকের প্রয়োজন পড়িবে। অনুরূপভাবে এই মুহূর্তে যক্ষ্মা চিকিত্সায় এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের খবরে আমরা আশান্বিত না হইয়া পারি না। আগামী বত্সর দেশের তিনটি জেলায় (ঢাকা, খুলনা ও পঞ্চগড়) প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংক্রান্ত পাইলট প্রকল্পের কাজ শুরু হইবে বলিয়া জানাইয়াছে ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইমুনোলজি অব বাংলাদেশ বা আইএসিআইবি। ভারতীয় উপমহাদেশে এখনো যক্ষ্মা শনাক্তে এইআই প্রযুক্তি ব্যবহারের পাইলটিং চলিতেছে। যুগের চাহিদা অনুযায়ী এই দেশেও এমন উদ্যোগের কথা যাহারা চিন্তাভাবনা করিতেছেন, তাহাদের আমরা স্বাগত জানাই। কেননা একসময় বলা হইত—যক্ষ্মা হইলে রক্ষা নাই। এখন সেইখানে এই রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হইয়াছে। তাহার পরও চলমান পদ্ধতিতে যক্ষ্মা নির্ণয়ে সমস্যা রহিয়াছে। সঠিকভাবে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করিতে না পারায় বহু রোগী দুর্ভোগ পোহাইতেছেন। ইহাতে অনেকে যক্ষ্মা শনাক্তের বাহিরে থাকিয়া যাইতেছেন। বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগব্যাধির ক্ষেত্রে আমরা যদি এইভাবে এআই প্রযুক্তির সাহায্যে সফলতা অর্জন করিতে পারি, তাহা হইলে ইহা আশীর্বাদ ছাড়া আর কী হইতে পারে?
বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এআইয়ের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানবজাতির জন্য ভয়াবহ হুমকির কারণ হইতে পারে বলিয়া ভবিষ্যদ্বাণী করিয়া গিয়াছেন। টেক জায়ান্ট গুগলের সাবেক প্রধান নির্বাহী এরিক স্মিড সকল কিছু পর্যবেক্ষণ করিয়া ইহা মানবসভ্যতা ধ্বংসের কারণ হইতে পারে বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী গ্যারি মার্কাস ইহাকে একটি কাচের ঘরে ষাঁড় ঢুকিয়া যাইবার সহিত তুলনা করিয়াছেন। তবে ইহা যতদিন মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে, ততদিন কোনো সমস্যা হইবে না। এই জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপরে একটি যৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ চান স্বয়ং চ্যাটজিপিটির প্রধান নির্বাহী জেমস ক্লেটনও। ইহার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করিয়া ইহার হিতকার ব্যবহারের প্রতি জোর দিতে হইবে সবচাইতে অধিক। যক্ষ্মা শনাক্তে এআই প্রযুক্তি ব্যবহারে সফলতায় সেই আশাবাদের বাণীই প্রতিফলিত হইতেছে বলিয়া আমরা মনে করি।