রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

মস্কো কনসার্ট হলে হামলায় যেভাবে জড়ালেন তাজিকরা

আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৪, ২২:১৮

মস্কোর কনসার্ট হলে ভয়াবহ হামলায় গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে একজন শামসিদ্দিন। তার জন্ম তাজিকিস্তানের লায়োব নামক গ্রামে। ঘটনার পর গ্রামবাসীদের প্রতিক্রিয়া নিতে সরাসরি গ্রামটিতে গিয়েছিল বিবিসি।

লয়োবের বাসিন্দারা বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে তাদের গ্রামের কেউ মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে জিহাদি গণহত্যায় অংশ নিতে পারে। কিন্তু ফরিদুন শামসিদ্দিন এখন মস্কোর একটি কারাগারে আটক চার তাজিক নাগরিকের একজন যাকে গত সপ্তাহে অন্তত ১৪৩ জনকে হত্যার অভিযোগে সন্দেহ করা হচ্ছে। ২৫ বছর বয়সী এই বন্দুকধারীদের সাহায্য করার জন্য আরও দু’জনকে নিয়োগ করার অভিযোগ রয়েছে।

তিনি কয়েক মাস আগে রাশিয়ায় কাজের সন্ধানে তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের লায়োব গ্রাম ছেড়েছিলেন।

তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের লায়োব গ্রাম। ছবি: বিবিসি

মস্কো হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, গত শনিবার তাজিক নিরাপত্তা বাহিনী লায়োবে পৌঁছায় এবং সন্দেহভাজনের বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায় বলে জানা গেছে। রুশ তদন্তকারীরা আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাজিকিস্তানে গিয়েছিলেন বলেও জানা গেছে।

এদিকে জিহাদি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বলেছে, তারা মস্কো হামলার জন্য দায়ী। এ সংক্রান্ত ভিডিও প্রমাণও তারা প্রকাশ করেছে। বিবিসি সেই ফুটেজটি যাচাইও করেছে। চার সন্দেহভাজন হামলাকারী আদালতে হাজির হওয়ার সময় তাদের গায়ে নির্যাতনের চিহ্নও দেখা গেছে। তাদের সাক্ষ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

শামসিদ্দিনের গ্রামে গিয়ে বিবিসি দেখেছে, লায়োবের জমি শুষ্ক। বেশি গরমও না বেশি ঠাণ্ডাও নয় এমন একটি পাহাড়ি গ্রাম এবং আশপাশে কোনো নদী নেই। গ্রামের যুবকরা প্রধানত কৃষি, নির্মাণ বা স্থানীয় বাজারে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।

রাশিয়ায় অভিবাসী হওয়া হাজার তাজিকের মধ্যে শামসিদ্দিনও একজন, যে তাজিকের স্বল্প মজুরি এবং অতি মাত্রার বেকারত্ব থেকে পালিয়ে অভিবাসী হওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে।

তাজিক কর্তৃপক্ষ বলছে, গত বছর ৬ লাখ ৫২ হাজারের বেশি মানুষ রাশিয়ায় অভিবাসন করেছে। তবে, রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ বলছে এই সংখ্যা দশ লাখও হতে পারে।

গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, তিন মাস পর শামসিদ্দিন রাশিয়া থেকে তুরস্কে যায় ও মার্চের শুরুতে আবার রাশিয়ায় ফিরে আসে।

শামসিদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদের ফুটেজ অনলাইনে দেখার পর একজন গ্রামবাসী বিবিসিকে বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে এতেটাই মারধর ও নির্যাতন করেছে যে সে লেনিনের মৃত্যুর দায় নিতেও প্রস্তুত।’

রাশিয়ান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ফাঁস করা তিন মিনিটের ভিডিওতে তাকে কাঁপতে দেখা যায়। এই সময় একজন সৈনিক তার চুল ধরে মাথা মাটিতে ঠুকে সৈনিকের বুট জুতার সঙ্গে ঠেলে দিচ্ছে বলেও দেখা যায়।

রাশিয়ান ভাষায় শামসিদ্দিন বলেছে, সে পাঁচ লাখ রুবলের বিনিময়ে মস্কোতে এই গণহত্যা চালিয়েছে।

তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রাহমন এই হামলাকে ‘লজ্জাজনক ও ভয়ঙ্কর ঘটনা’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি তার দেশের জনগণকে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রভাব থেকে শিশু ও যুবকদের রক্ষা করতে আহবান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ‘তাজিক জাতির সুনামকে ভূলুণ্ঠিত না করার’ও আহবান জানিয়েছেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেছেন, জিহাদিদের পশ্চিমারা ও ইউক্রেনিয় গোয়েন্দারা সাহায্য করেছিল। যে দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে ইউক্রেন।

তাজিক প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ফোনে এই হামলার নিন্দা জানিয়ে কথা বলেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে তিনি বলেছেন, ‘সন্ত্রাসীদের কোনো জাতীয়তা নেই, দেশ নেই, ধর্ম নেই।’

পুতিনের সঙ্গে তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রাহমন। ছবি: বিবিসি থেকে

তাজিকদের প্রতিক্রিয়া

শুক্রবারের হামলার পর রাশিয়ায় কর্মরত তাজিক নাগরিকরা ইতোমধ্যেই বেশ সমস্যার সম্মুখীন হতে শুরু করেছে। মস্কোতে একজন তাজিক অভিবাসী শ্রমিক বলেছেন, তার এলাকায় সে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বাড়াতে দেখেছে। যারা দেখতে এশিয়ান তাদের নথিপত্র পুলিশ যাচাই করে দেখছে। যাদের কাগজপত্র নেই তাদের নির্বাসনের ঝুঁকি রয়েছে।

তাজিকিস্তানের প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকে এক বা একাধিক সদস্য কাজের জন্য রাশিয়ায় পাড়ি দিয়েছে। মধ্য এশিয়ার ক্ষুদ্র ও দরিদ্র এই দেশের অর্থনীতির জন্য তাজিক অভিবাসীদের পাঠানো অর্থ গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।

ভ্লাদিমির পুতিনের একজন গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, রাশিয়ান রাজনীতিবিদ সার্গেই মিরনভ জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর লোকদের জন্য ভিসামুক্ত প্রবেশ বাতিল করার প্রস্তাব করেছেন।

তিনি বিশ্বাস করেন, সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলায় রাশিয়ান সরকারকে অভিবাসন প্রক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠোর করতে হবে।

কীভাবে ইসলামিক স্টেট তাজিকদের দলে ভেড়ায়

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আইএস-এ যোগদানকারী বেশির ভাগ তাজিক নাগরিক হল রাশিয়াতে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিক, যাদের সোশ্যাল মিডিয়া বা টেলিগ্রামের মতো মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে দলে নেওয়া হয়েছে।

ইসলামিক স্টেটের এই সাম্প্রতিক হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্তদের কেউ কেউ স্বীকার করেছেন যে তাদের সঙ্গে অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছিল।

তাজিক সরকার বলেছে, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে আইএসে যোগদানকারী দুই হাজার নাগরিকের বেশির ভাগকেই রাশিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো।

দুশানবে ভিত্তিক সেন্টার ফর আফগানিস্তান স্টাডিজের প্রধান কাসিম শাহ ইস্কান্দারভ মনে করেন, মধ্য এশিয়ার দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকরা ‘র‍্যাডিক্যাল’ বা উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোতে নিযুক্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

আইএসের সাম্প্রতিক লজিস্টিক হাব হিসেবে তুরস্কের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, তাজিক ও রাশিয়ানরা যেখানে ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ করতে পারে।

তুরস্ক অবশ্য জোর দিয়ে এটা বলেছে, সাম্প্রতিক হামলায় যুক্ত তাজিকরা সেখানে গিয়ে উগ্রপন্থী হয়নি, বরং আগেই হয়েছে। অভিবাসী কর্মীদের রাশিয়ায় প্রবেশের পর তিন মাসের মধ্যে একটি বাসস্থান ও ওয়ার্ক পারমিট পেতে হবে। যার খরচ পড়ে প্রায় ৪৩০ ডলার বা ৪০ হাজার রুবল।

কিছু অভিবাসী তিন মাসের সময়সীমা শেষ করার আগেই রাশিয়া ছেড়ে তুরস্কে যায় এবং অর্থ পরিশোধ এড়াতে রাশিয়ায় পুনরায় প্রবেশ করে।

ইস্কান্দারভ মনে করেন, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রাথমিক ঘাঁটি আফগানিস্তান। অনেক তাজিকেরই সেখানে মগজ ধোলাই করা হয়েছে।

আফগানিস্তানের ভূমিকা

তাজিকিস্তানের দক্ষিণে আফগানিস্তানের সীমানা। বিভিন্ন প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়েছে, ২০২১ সালের আগস্টে তালিবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে, আফগানিস্তানে আইএস ও আল-কায়েদার মতো সংগঠন এবং গোষ্ঠীর উপস্থিতি বেড়েছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সর্বশেষ প্রতিবেদনেও আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগগুলির সক্রিয়তাকে এখনো আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে ক্ষুণ্ণ করার একটি কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল।

রাশিয়ার নেতৃত্বে একটি সামরিক ব্লক হল ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ (সিএসটিও)। যার মধ্যে রয়েছে বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, আর্মেনিয়া (সম্প্রতি যার সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে) ও তাজিকিস্তান।

গত মাসে সিএসটিও বলেছে, তাজিকিস্তানের দক্ষিণ সীমান্তে আইএস যোদ্ধা ও অন্যান্য জঙ্গিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সংস্থার মতে, এই গোষ্ঠীগুলোর জন্য প্রশিক্ষণ শিবিরের নেটওয়ার্কও বিস্তৃত হচ্ছে। তাদের বেশির ভাগ বিদেশি যোদ্ধা তাজিকিস্তানের সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের।

টাইমলাইন: তাজিকরা যেভাবে আইএসে যুক্ত হয়েছে

১৪ই আগস্ট ২০২৩: ইরানে সশস্ত্র হামলায় একজন নিহত হয়। মূল সন্দেহভাজন একজন তাজিক নাগরিক।

৩রা জানুয়ারি ২০২৪: দক্ষিণ ইরানে আত্মঘাতী হামলায় কম পক্ষে ৮৯ জন নিহত হন। দুইজন তাজিক নাগরিক জড়িত ছিলেন।

২৮শে জানুয়ারি ২০২৪: তুরস্কে ক্যাথলিক চার্চে হামলায় একজন নিহত হন। একজন তাজিক সন্দেহভাজন।

গত ১০ বছরে তাজিকিস্তানে ছয় হাজার ৬৮০টি সন্ত্রাসবাদী ও চরমপন্থী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

গত তিন বছরে ২৪ জন তাজিক নাগরিক ১০টি ভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে।

দুই হাজার তাজিক নাগরিক আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া ও ইরানে গিয়েছিল। তাদের অর্ধেককে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রায় চার হাজার ৭৫ জন তাজিক নাগরিককে ‘চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ চালানোর জন্য বিচার করা হয়েছে।

ইত্তেফাক/এসএটি