শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

রোজায় যানজট প্রেক্ষাপট ঢাকা মহানগরী

আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৩০

ঢাকা মহানগরীর বিদ্যমান যানজটকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বর্তমান পুলিশ কমিশনার জনাব হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার)-এর নেতৃত্বে কাজ করে যাচ্ছে টিম ট্রাফিক ডিএমপি। জনগণ যেন নিরাপদে ভ্রমণ করে স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পারে, সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে ডিএমপির সব ট্রাফিক বিভাগ। বিভিন্ন জাতীয়, আন্তর্জাতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক উত্সব/অনুষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করে ঢাকা মহানগরীর যানজটের চিত্র বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। পবিত্র রমজান মাসে ঢাকার যানজট অন্য মাস থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। মুসলিম ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য রমজান মাস অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ একটি মাস। আত্মশুদ্ধির লক্ষ্যে এবং আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিশ্বের সব মুসলমান দীর্ঘ একটি মাস রোজা রাখে। বছরের অন্যান্য মাস থেকে এই মাসে মানুষের জীবনযাপন-পদ্ধতি ভিন্ন হয়ে থাকে। বিশেষ করে, ঢাকা মহানগরীতে স্বাভাবিকের তুলনায় সাধারণত রাস্তাঘাটে মানুষ এবং যানবাহনের সমাগম অনেক বেশি থাকার কারণে যান চলাচল স্বাভাবিকভাবে একটু বেশি বিঘ্নিত হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় রমজানে যানজট তুলনামূলকভাবে অন্য মাসের তুলনায় বেশি হওয়ার কিছু সাধারণ ও ব্যতিক্রমী কারণ হলো :

১. মানুষ চাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, লেখাপড়া ও বাজার করার কাজে ঘরের বাহিরে বের হয়। তারা বিভিন্ন সময়ে ঘরে ফেরত আসে। কিন্তু রমজান মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ যে উদ্দেশ্যেই ঘর থেকে বাহির হোক না কেন, তারা ইফতারের আগে বাসায় ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সেক্ষেত্রে সব যানবাহন এবং পথচারীর ইফতারের সময়ের আগে ঘরে ফেরার প্রবণতায় যানবাহনের আধিক্য ঘটে এবং রাস্তায় যানজট হয়। ২. ঈদ ও নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনের কেনাকাটায় মানুষের মার্কেট ও বাজারকেন্দ্রিক যাতায়াত অনেক বেশি থাকে। ফলে সেই এলাকাগুলোতে রিকশাসহ অন্যান্য যানবাহনের আধিক্য ঘটে। ৩. আরবি বছরের বাকি ১১ মাসে যেসব মানুষ সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বাহির হতো না, তারা সন্ধ্যায় ইফতারের পর মার্কেটের উদ্দেশে বের হন। যানজট তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়। ৪. ফুটপাত ও রাস্তাকেন্দ্রিক যেসব হকার সারা বছর ব্যবসা করেন, রমজান মাসে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপনের জন্য এবং বেশি মুনাফা লাভের আশায় তাদের ব্যাবসায়িক তত্পরতা বেশি দেখা যায়। এসব হকারের জায়গা দখলের কারণে রাস্তা সরু হয়। ৫. দিনে ও রাতে শহরের মধ্যে বিপুল লোকের যাতায়াতের কারণে যানজট সৃষ্টি হয়। ৬. বিপুলসংখ্যক ব্যাটারিচালিত গাড়ি রাস্তার আইল্যান্ড ঘেঁষে চালানোর কারণে তাদেরকে প্রতিহত করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। তাদের অধিক চলাচল রাস্তায় যানজট সৃষ্টি করে। ৭. ঈদের এক থেকে দুই সপ্তাহ আগে প্রচুর পরিমাণে অনুমোদনের বাইরে যানবাহন আন্তঃজেলাভিত্তিক চলাচল করে। এসব পরিবহনের নির্ধারিত কাউন্টার নেই। যেখানে-সেখানে ট্রাফিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাস্তার মাঝখান থেকে যাত্রী ওঠানামা করে। ৮. গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়ার লক্ষ্যে আগে থেকে ঈদের টিকিট কাটার জন্য কাউন্টারগুলোতে অস্বাভাবিক মানুষের ভিড় রাস্তাকে সংকীর্ণ করে দিয়ে যানজট সৃষ্টি করে থাকে। ৯. বিভিন্ন সংস্থা তাদের কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে। এতে রাস্তা সরু হয়ে সর্পিলাকার ধারণ করে। ১০. ঢাকা মহানগরীতে বিদ্যমান রাস্তার তুলনায় অধিকসংখ্যক গাড়ি চলাচল করে। ১১. শহরের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন জেলাগামী রেললাইন রয়েছে। তাছাড়া ঈদের আগে অতিরিক্ত ট্রেন দেওয়া হয়। রেলক্রসিংয়ের সময় রেলক্রসিং-সংলগ্ন অন্যান্য যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। ১২. একই পরিবারের দুই বা ততোধিক প্রাইভেট কার ব্যবহার করা। ১৩. আইন অমান্যের প্রবণতা বৃদ্ধি এবং আইন প্রয়োগ করতে গেলে অজুহাত প্রদর্শন।  ১৪. তুলনামূলক অপ্রশস্ত রাস্তা। ১৫. সাধারণ জনগণের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান না থাকা। ১৬. রমজানের শুরুতে যাত্রী কম থাকায় পরিবহনগুলো যত্রতত্র থামানোর চেষ্টা করে। ১৭. একই লেনে বিভিন্ন গতির গাড়ি একসঙ্গে চলা; যেমন বাস, প্রাইভেট কার, রিকশা ইত্যাদি। ১৮. রাস্তায় খানাখন্দক থাকা, রাস্তা কর্দমাক্ত ও ভাঙাচোরা হওয়ার কারণে গাড়ির গতি কমে যাওয়া। ১৯. হানিফ ফ্লাইওভারসহ অন্যান্য ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ের টোল দিতে গিয়ে প্রতিটি গাড়ি থামছে। সেক্ষেত্রে ফ্লাইওভার-কেন্দ্রিক যানজট হচ্ছে। ২০. ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ের মুখগুলো ঢাকা শহরের যেখানে নামছে, সেখানে গাড়ির আধিক্য থাকার কারণে যানজট হচ্ছে। ২১. ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ের মাঝখানে তরুণ প্রজন্ম মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য গাড়ি পার্ক করে আড্ডা দিচ্ছে। এতে গাড়ির স্বাভাবিক গতি কমে গিয়ে যানজট হচ্ছে। ২২. রাস্তার মাঝখানে ফ্লাইওভারের মুখে বিভিন্ন পরিবহন থেকে সিটি টোলের নামে অজ্ঞাত ব্যক্তি কর্তৃক চাঁদাবাজির কারণে যানজট হয়। ২৩. যানবাহনের তুলনায়  বাস টার্মিনাল অপ্রতুল। রাস্তাঘাটে পরিবহনগুলো পার্ক করে রাখে। রাস্তা সরু হয়ে যানজট সৃষ্টি করে। ২৪. হানিফ ফ্লাইওভারের মতো ফ্লাইওভারের ভিত্তি/পিলারের পাদদেশ প্রশস্ত হওয়ায় রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছে। ফলে ফ্লাইওভারের নিচে দুটো গাড়ি পাশাপাশি চলা কষ্ট হয়ে যায় এবং যানজট সৃষ্টি হয়। ২৫. বিভিন্ন নদীর ওপর বৃহত্ সেতু হওয়ায় এবং যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ায়, বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে প্রবেশমুখগুলোয় আগের তুলনায় গাড়ির আধিক্য বেড়েছে।  ২৬. যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা এলাকার মতো অনেক এলাকায় মূল রাস্তা বা মেইন রোডের সঙ্গে থাকা অসংখ্য ফিডার রোডের গাড়ি মূল সড়কে চলে এসে যানজট সৃষ্টি করে। ২৭. সিটি করপোরেশনের ময়লার ভ্যান ও বড় গাড়ি উলটো পথে এসে যানজট সৃষ্টি করে। ২৮. রাত ১০টা থেকে দেড় টনের অধিক ওজনের ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্রেইলার গাড়ি শহরে প্রবেশ করায় যানজটের সৃষ্টি হয়। ২৯. পবিত্র রমজান মাসকে উদ্দেশ্য করে প্রায় ৫০ হাজার ভিক্ষুক ঢাকা শহরে আসে, যার ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়।

সমাধান :১. ঢাকা মহানগরীতে রোজাদারসহ সব নাগরিক ও যানবাহনের চালককে বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রে ধৈর্যশীল হতে হবে। কোনো প্রকার ওভারটেকিং বা তাড়াহুড়া করা যাবে না। ২. মার্কেটগুলোতে ট্রাফিক এবং কমিউনিটি পুলিশ দিয়ে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা। ৩. হকারদেরকে ফুটপাত ও রাস্তা থেকে উপযুক্ত স্থানে সরিয়ে নেওয়া। ৪. রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে জেব্রা ক্রসিং বা ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা। ৫. ব্যাটারিচালিত গাড়ির বিরুদ্ধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় ব্যবস্থা নেওয়া। ৬. ঈদ উপলক্ষ্যে যত্রতত্র গাড়ির কাউন্টার স্থাপন না করতে দেওয়া। ৭. রমজান মাসে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি না করতে দেওয়া। ৮. যান চলাচলের জন্য নতুন নতুন সড়ক সৃষ্টি করা। ৯. মানুষের চাপ কমানোর জন্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের সুযোগ-সুবিধা জেলা পর্যায়ে দেওয়া। পাশাপাশি জেলাগুলোতে নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি করা।  ১০. ব্যক্তিগত গাড়ির আধিক্য ঠেকাতে একই পরিবারে দুটির বেশি গাড়ি না দেওয়া। ১১. আইন মানার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি নেওয়া এবং কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা। ১২. সংকীর্ণ রাস্তাকে আরো প্রশস্ত করা। ১৩. ট্রাফিক আইন সম্পর্কে প্রচারণা চালানো। ১৪. গণপরিবহনগুলোকে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করতে না দেওয়া। ১৫. ফুটপাত ও ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা। ১৬. একই রাস্তায় মোটরযান ও ম্যানুয়াল গাড়ি একসঙ্গে চলতে না দেওয়া।  ১৭. ফ্লাইওভারের টোল আদায়ের ক্ষেত্রে আরো আধুনিক ব্যবস্থা নেওয়া; যেমন আরএফআইডি কার্ড এবং সেন্সর কার্ড ব্যবহার করা । ১৮. যে রাস্তায় যানজট কম, সে রাস্তায় ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ের মুখ নামানো। ১৯. ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ের ওপর গাড়ি থামিয়ে আড্ডা দেওয়া বন্ধ করার ব্যবস্থা করা। ২০. সিটি টোলের নামে অজ্ঞাত চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। ২১. অধিক পরিমাণে বাস টার্মিনাল ও বাসস্টপ তৈরি করা। ২২. ফ্লাইওভারের পিলারের নিচের বেদির প্রশস্ততা কমিয়ে দুটো গাড়ি পাশাপাশি চলতে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।  ২৩. ফিডার রোড থেকে রিকশা, ভ্যান ও অটোরিকশা মেইন রোডে আসতে না দেওয়া। ২৪. ময়লার গাড়ি যেন উলটো পথে এসে যানজট সৃষ্টি না করে, তার ব্যবস্থা নেওয়া।  ২৫. নির্দিষ্ট সময়ের আগে দেড় টনের অধিক ওজনের গাড়ি শহরে প্রবেশ করতে না দেওয়া। ২৬. মার্কেটসমূহে নিজস্ব পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা। পার্কিংয়ের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকলে ভবিষ্যতে কোনো মার্কেট অনুমোদন না দেওয়া। ২৭. দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাতে অটোগাড়ি ও ম্যানুয়াল গাড়ি একসঙ্গে চলতে না দেওয়া।

লেখক: ডিসি, ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগ, ডিএমপি

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন