(গতকালের পর)
বাংলাদেশে বাজার গবেষণা করার জন্য একটি বড় অন্তরায় হলো প্রকৃত তথ্য ও তথ্যের উেসর অভাব। অন্যদিকে এ দেশের বিপণনকারীরা পণ্যের প্রকৃত গুণাগুণ অনেক সময়ই গোপন করে ভুল এবং অতিরঞ্জিত বর্ণনা দিয়ে থাকেন। বিপণনে নৈতিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুতরাং পণ্যের মান, গুণ, উত্পাদনের উপকরণ, পরিমাণ, মেয়াদ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমূহ যথাযথভাবে ভোক্তাকে জানানো প্রয়োজন; যা ভোক্তার সন্তুষ্টি ও আস্থা অর্জনে সহায়তা করে। উন্নত দেশগুলোর মতো এখনো ভোক্তাদের অধিকার ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আইনকানুন পুরোপুরি অনুসরণ না করার ফলে ভোক্তারা অনেক সময়ই বিপণনকারীদের দ্বারা প্রতারিত হয়।
ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে বাংলাদেশে বিপণন কার্যক্রম আরো শক্তিশালী হবে। তবে তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আপত্কালীন মজুত গড়ে তোলা। সরকার আপত্কালীন মজুত গড়ে তোলার মাধ্যমেও পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে পণ্যের দাম বাড়ায়। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম স্থিতিশীল থাকে।
সরকার যদি সরাসরি ভোজ্য তেল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানি ও বাজারজাত করত, তাহলে ব্যবসায়ীরা এ সুযোগ নিতে পারত না। যেমন—সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করে, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্জিত হয় না। কারণ বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্য নির্ধারণ, ক্রয়কাজে জটিলতাসহ নানাবিধ কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। এছাড়া যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তাও কম। মৌসুমি শাকসবজি, ফল ইত্যাদি সংরক্ষণ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। দেশব্যাপী ছোট ছোট হিমাগার গড়ে তুলে এসব সংরক্ষণ করা যেতে পারে। একটি পণ্য ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে কমপক্ষে ছয়টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়—
১. প্রান্তিক কৃষক তার উত্পাদিত পণ্য সামগ্রী স্থানীয় হাট বাজারে নিয়ে যান;
২. কৃষি পণ্যগুলো সংগ্রহ করেন পাইকার, ব্যাপারী ও মজুতদার;
৩. তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন বিভিন্ন এজেন্ট;
৪. এজেন্টরা তাদের পণ্য জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের আড়তে নিয়ে আসেন;
৫. আড়ত থেকে পণ্যগুলো সংগ্রহ করেন খুচরা বিক্রেতারা;
৬. খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে ভোক্তারা;
সবাই যদি প্রতি কেজি পণ্যে পাঁচ টাকা করেও লাভ করেন ৩০ টাকা মূল্য বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যা ক্রেতাকে বহন করতে হয়। রংপুরে এক টাকা কেজি বেগুন ঢাকার খুচরা বাজারে ৩০ টাকায় বা আরো বেশি দামে বিক্রি হয়। মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটের কবল থেকে এই সরবরাহ ব্যবস্থাকে মুক্ত করতে হবে। প্রান্তিক কৃষকদের কৃষি পণ্য সরকারি উদ্যোগে খুচরা বাজারে সরবরাহের ব্যবস্থা করবে, এজন্য প্রান্তিক কৃষক ও কৃষকদের উত্পাদিত পণ্যের পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করা প্রয়োজন।
সব কৃষক অ্যাপস এর মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করবে। সরকার-নির্ধারিত দামে ১০ থেকে ২০ শতাংশ লভ্যাংশে কৃষক পণ্য বিক্রয় করবেন, তাহলে প্রান্তিক কৃষক লাভবান হবেন এবং উত্পাদনে আগ্রহী হবেন। কৃষক ও ভোক্তার মাঝখানে সেতুবন্ধ তৈরি করে দেবে প্রযুক্তি, ব্লক চেইন প্রযুক্তি হতে পারে একটি কার্যকরী সমাধান। স্মার্ট বাংলাদেশের কৃষি ও বাজার ব্যবস্থাপনা হতে হবে আধুনিক ও স্মার্ট। প্রান্তিক কৃষকেরা ইউনিয়ন পরিষদের বিক্রয় কেন্দ্রে পণ্য বিক্রি করবেন। স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তদারকি এবং সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করবেন।
আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক দেওয়ার পর একজন ব্যবসায়ীর লাভ ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। একটি পাউরুটি তৈরি করতে উত্পাদনকারী ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিচ্ছে সরকারকে; ডিস্ট্রিবিউটর আবার ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিচ্ছে, ক্রেতা আবার ভ্যাট দিয়ে সেটি কিনছেন, এভাবে দাম বেড়ে যাচ্ছে। একটি পণ্যে এভাবে বারবার ভ্যাট প্রদান কোনোভাবেই কাম্য নয়, শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকেই বাড়তি চাপ বহন করতে হয়, তাই আমাদের শুল্কব্যবস্থায় আমূল সংস্কার প্রয়োজন।
আসলে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এভাবে দাম বেঁধে দেওয়া খুব বাস্তবসম্মত নয়। একইভাবে সম্ভব নয় ব্যবসায়ী-বিক্রেতারা কোন পণ্যে কতটা বা কী হারে মুনাফা করবে, তা নির্ধারণ করা। বরং, পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন ধাপে অবৈধ লেনদেন, চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করা যৌক্তিক পদক্ষেপ। একই সঙ্গে বিভিন্ন পণ্যের উত্পাদন, আমদানি, চাহিদা ও দামের সঠিক ও বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সরকারের হাতে থাকা আবশ্যক যেন এসব তথ্য নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। সেই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিভিন্ন পণ্যের সম্ভাব্য বা নির্দেশক Benchmark দাম নিয়মিত প্রকাশ ও প্রচার করা যেতে পারে। তাতে করে ভোক্তারা অন্তত এটা ধারণা করতে পারবেন যে তারা কতটা বেশি দিয়ে কিনছেন। এতে করে সব ধরনের বিক্রেতার ওপর একটা নৈতিক চাপও তৈরি হবে। সর্বোপরি দেশে যে বড় ধরনের আয়-বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তাও প্রতিফলিত হচ্ছে উচ্চ দামে তথা মূল্যস্ফীতিতে। মোট জনগোষ্ঠীর তুলনায় আনুপাতিক হারে অনেক কম হলেও একটা বড় অংশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এতটাই বেশি যে কোনো উচ্চমূল্যই তাদের কাছে বাধা নয়। এরা বরং সামগ্রিক চাহিদা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে, যার প্রভাব পড়ছে দামে, বাড়ছে ব্যয়ের বৈষম্যও। অন্তত সাদাচোখে তাই দেখা যাচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে, দিনে দিনে আয়বৈষম্য বাড়ছে। বলা বাহুল্য, এ লক্ষণ আমাদের ভবিষ্যত্ বাংলাদেশের জন্য অশুভ। স্বাধীনতার ৫৩ বছর কেটে গেছে। এখনই সময় এসব বিপজ্জনক লক্ষণ দূর করার। এসবের কারণ কী? উগ্র বাজার অর্থনীতিই যে প্রধান কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তান আমলের মিশ্র অর্থনীতি ছেড়ে স্বাধীনতার পর আমরা সমাজতন্ত্রের পথ ধরি। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা এ চারটি হয় আমাদের মূলনীতি। সংবিধানে যা-ই থাকুক না কেন, বাস্তবে আমরা ‘বাজার অর্থনীতি’ (Market Economy) অনুসরণ করছি না, অনুসরণ করছি ‘উগ্র বাজার অর্থনীতি’ যার কোনো মানবিক দিক নেই। (Bank financed growth) রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিই আমাদের প্রধান উপায়। আমাদের রাজস্ব বাড়ে না, খরচ বাড়ে। উন্নয়নের কাজ চলে ঋণের টাকায়। অবকাঠামো গড়ে ওঠে বিদেশি ঋণে। আবার উন্নয়নের টাকা, ব্যাংকের টাকা চুরি হয়। পরিকল্পনা কমিশনের মতে, যারা সরকারি সাহায্য পাওয়ার কথা তারা পায় না, যারা পাওয়ার কথা নয় তারা পায়।
নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ব্যর্থ হয়ে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে পুঁজি করে দেশের অভ্যন্তরে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারায় লিপ্ত। তাদের অপরাজনীতির কারণে বাংলাদেশের জনগণ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। তারা বিদেশি পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে আবার নিজেরাই গোপনে সেসব পণ্য ব্যবহার করছে। কোনো সরকারই অহেতুক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করে নিজেদের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করতে এবং জনপ্রিয়তা হ্রাস করতে ইচ্ছুক নয়। পণ্যের মূল্য বেঁধে দিয়ে স্থায়ীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, বরং এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকারের কৃতসংকল্পতা, তদারকি ও বাস্তবায়ন না থাকলে সমূহ সমস্যার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাজার প্রতিকূলতা সৃষ্টিকারী, মজুতদার, মুনাফাখোর, চাঁদাবাজ ও মাস্তানদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর আমলের শক্তিশালী টিসিবিকে আবারও উজ্জীবিত করে বাফার স্টক করতে সাহায্য করা, কৃষকদের মধ্যে সমবায় বিপণন ব্যবস্থার প্রচলন, পণ্য সংরক্ষণক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে ঋণসুবিধা এবং মুক্তবাজারে বিক্রির সময়সীমা কয়েক মাস ধরে রাখা ইত্যাদি পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সময়োচিত পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য চাই স্মার্ট কৃষি ও বাজার ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের বাজার পরিণত হোক কৃষকের আনন্দের হাসি এবং জনগণের স্বস্তির নিঃশ্বাসের মিলনমেলায়।
লেখক: ফিকামলি তত্ত্বের জনক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রেসিডিয়াম সদস্য, বঙ্গবন্ধু পরিষদ