বিগত ছয় মাস ধরে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল। দুঃস্বপ্নের শুরুটা হামাসের হাত ধরে। ইসরাইল ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনের এই স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী অকস্মাত্ হামলা চালিয়ে বসলে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় পালটা হামলা শুরু করে ইসরাইল। সেই থেকে যুদ্ধ চলছে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে। গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধে এখন পর্যন্ত বহু হতাহত হয়েছে। ৪০ হাজারের গণ্ডি স্পর্শ করতে চলেছে নিহতের সংখ্যা। আহত মানুষের সংখ্যা ৮০ হাজারের মতো। ইসরাইলি বাহিনীর আক্রমণ ও হামলার মুখে গাজা উপত্যকা পরিণিত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। খোদ জাতিসংঘের ভাষ্য, বসবাসের উপযোগী নেই গাজা ভূখণ্ড। আরো দুঃখজনক কথা, এই যুদ্ধে নিহতদের বেশির ভাগই শিশু ও নারী।
ইসরাইলে হামাসের চালানো হামলায় বহু ইসরাইলি নিহত ও আহত হন। বলা হচ্ছে, হামাসের এই নৃশংসতা হলোকাস্টের পর থেকে ইহুদি জনগণের ওপর চালানো সবচেয়ে মারাত্মক হামলা। হামাসের হামলা এবং এর সূত্র ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর পালটা হামলায় গোটা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বব্যাপী যে দুর্ভোগ, দুর্দশা নেমে এসেছে, তার শেষটা কী হবে, তা কারো জানা নেই! হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান যুদ্ধে কে জিতবে—এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিনই। তবে নিরপেক্ষভাবে বললে, যুদ্ধে জেতেনি কোনো পক্ষই। ক্ষুধা ও হতাহত ছাড়া গাজা যুদ্ধে যেন কিছুই চোখে পড়ে না। হামাসের হাতে আটক ইসরাইলিদের এখনো মুক্ত করা যায়নি। কিছু সময়ের জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাশ হয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের বদলৌতে। যদিও ইসরাইল যুদ্ধবিরতির শর্ত মানছে না একদমই। যুদ্ধ চলতে থাকলে একটা সময়ে হয়তো হামাস সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিংবা তাদের ক্ষমতার দাপট কমে যেতে পারে। তবে প্রশ্ন হলো, তাতেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব শেষ হয়ে যাবে?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সংঘাতে ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর। লক্ষ করার বিষয়, বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে রয়েছেন নেতানিয়াহু। ঘরে-বাইরে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। তার ওপর নাখোশ খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এসবের ফলে নেতানিয়াহুকে মূল্য চোকাতে হতে পারে বলেই বিশ্লেষকদের অভিমত।
আরো লক্ষণীয়, হামাস-ইসরাইল দ্বন্দ্ব বিশ্বব্যাপী ইহুদিবাদের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। একধরনের ঘৃণা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে এর মধ্য দিয়ে। উপরন্তু উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপ জুড়েই। আমেরিকান ইহুদিদের অভিমত, ‘একটি দেশ তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল, যা এখন আর নেই। বরং তারা বিদ্বেষের মুখোমুখি।’ এক্ষেত্রে বলতে হয়, শুধু ইহুদিবিদ্বেষ নয়, বেড়েছে মুসলিমবিরোধী গোঁড়ামিও। এই যে ভয়ংকর অধ্যায়, এর শুরুটা হয় হামাসের খামখেয়ালীপনায়, এতে দ্বিমত নেই। কারণ, তারাই প্রথম হামলা চালিয়েছে। সুরক্ষিত সীমানা লঙ্ঘন করে ইসরাইলিদের ওপর বর্বর হামলা করেছে। এটা কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না।
খারাপ খবর হলো, ১ হাজার ২০০ ইসরাইলিকে হত্যার পাশাপাশি আরো শতাধিক বাসিন্দাকে জিম্মি করে নিয়ে যায় ইরানের অন্যতম মিত্র হামাস। এখনো অনেকেই হামাসের হাতে আটক। মূলত ঝামেলা হচ্ছে এ নিয়েই। হামাসকে নির্মূল করে তাদের কাছ থেকে বন্দি ইসরাইলিদের মুক্ত করার চিন্তা থেকেই গাজা জুড়ে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে আসছে ইসরাইলের সেনারা। যদিও তাতে মারা পড়ছে কেবল নিরীহ বেসামরিক মানুষ। ইসরাইলি বাহিনী আইডিএফ বিশ্বাস করে, এখনো প্রায় ১০০ ইসরাইলিকে জিম্মি করে রেখেছে হামাস। এই জিম্মিদের মুক্ত করতে ইসরাইল সামনের দিনগুলোতে হামলা অব্যাহত রাখবে বলেই ধরে নেওয়া যায়। এর ফলে ফিলিস্তিনে কী ধরনের পরিস্থিতি লক্ষ করা যাবে, তা কল্পনারও বাইরে।
গাজাবাসীর যেন দুঃখের শেষ নেই! ত্রাণ নিতে আসা লোকজন নির্বিচার হামলার শিকার হচ্ছে। হামলা চালিয়ে হত্যা করা হচ্ছে হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে আসা রোগীদের পর্যন্ত। এই অবস্থার মধ্য দিয়েই রমজান পালন করবেন ফিলিস্তিনের ধর্মপ্রাণ মুসলমান। পবিত্র ইদুল ফিতরের উত্সব পালিত হবে এহেন পরিস্থিতির মধ্যেই। ট্র্যাজিক হিস্ট্রি বটে!
খেয়াল করার বিষয়, ইসরাইলে হামাসের ভয়াবহ হামলা এবং ইসরাইলিদের জিম্মি করার ঘটনার পর বিশ্ব সম্প্রদায় ইসরাইলের প্রতি সমর্থন জানায় প্রথম দিকে। হামলাকারী হামাসের নিন্দায় ফেটে পড়ে বিশ্ব জনমত। তবে এরপর ইসরাইল যখন হামাস নিধনের নামে গাজার হাজার হাজার নারী, শিশু ও বৃদ্ধকে নির্বিচারে হত্যা করে, তখন তেল আবিবের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন বিশ্বনেতারা। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, এমনটা যে ঘটবে, তা বেশ ভালো করেই জানত হামাস এবং ঠিক সেই সুযোগাটাই নিয়েছে তারা!
যাহোক, এই সংঘাতে বরাবরের মতোই সবচেয়ে বড় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে দুই দেশের সাধারণ জনগণ। উভয় পক্ষের বেসামরিক নাগরিকদের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। গাজার ফিলিস্তিনিরা এক দুঃসহ জীবন পার করছে। অন্যদিকে, যেসব ইসরাইলি হামাসের হাতে এখনো জিম্মি রয়েছে, তাদের পরিবারও দিন কাটাচ্ছে ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে। উভয় পক্ষের বেসামরিক মানুষের জীবনে কী ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে, তা সহজেই অনুমেয়। হামাসের নিন্দাবাদ, প্রতিবেশী আরবদের ভূরাজনৈতিক উদ্বেগ এবং যেকোনো মূল্যে ইসরাইলের জয়ী হওয়ার সংকল্প—এই ত্রিশঙ্কুর মধ্যে আটকা পড়েছে গাজাবাসীর জীবন। নির্বাসনে থাকা হামাস নেতারা প্রথম দিকে ঘোষণা করেছিলেন, ‘শহিদদের বলিদানে তারা গর্বিত’। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের কথায় গাজাবাসীর কী লাভ? গাজার হাজার হাজার পরিবার মাটির সঙ্গে মিশে গেছে ইসরাইলি হামলার মুখে। পরিবারহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার শিশু। বহু নারীর জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় অধ্যায়। সুতরাং, কেবল কথার কথায় গাজাবাসীর দুর্ভোগ শেষ হবে?
ইসরাইলের ভাষ্য, হামাস যোদ্ধারা গাজায় লুকিয়ে আছেন। জনগণের মধ্যে মিশে আছেন। আর এ কারণেই হাসপাতালগুলোতে পর্যন্ত আক্রমণ চালাচ্ছে তারা। হামাস যদি সত্যি সত্যিই শহিদের রক্তের মূল্য বুঝত, নিরীহ গাজাবাসীর দুর্ভোগের বিষয়কে বড় করে দেখত, তাহলে তারা হয়তো গাজাবাসীকে বাঁচাতে আরো অনেক কিছু করত। ফলে বেসামরিক লোকদের হত্যা করার সাহসও দেখাত না ইসরাইল।
বেশির ভাগ যুদ্ধে বেসামরিক লোকদের যুদ্ধকবলিত অঞ্চল থেকে পালানোর সুযোগ দেওয়া হলেও গাজার জনগণের ভাগ্যে তা জোটেনি। তারা ইচ্ছা করুক বা না করুক, গাজা অঞ্চল ছেড়ে তাদের বের হওয়ার তেমন কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। এমনকি হামাসও গাজাবাসীকে নিজ অঞ্চলে থাকার আহ্বান জানিয়েছে। এর ফলে হতাহত বেড়েছে নিঃসন্দেহে। নির্মম সত্য এই যে, এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের জীবন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়নি কারো কাছেই। এর পাশাপাশি পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলেছে ইসরাইলের রাজনৈতিক সংকট।
আমার মতো অনেকেই নেতানিয়াহুর সমালোচনা করতে চাইবেন। সত্যি বলতে, কেবল এখন নয়, ৭ অক্টোবরের আগ পর্যন্তও ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় সবার ওপরে থাকবে তার নাম। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ইসরাইলির চাওয়া, নেতানিয়াহু সরে যাক ক্ষমতা থেকে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, তিনি কি আপনা আপনিই সরে যেতে চাইবেন? এর চেয়েও বড় প্রশ্ন, তিনি চলে গেলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে রাতারাতি?
গাজা যুদ্ধের হাত ধরে এই অঞ্চল তো বটেই, গোটা বিশ্বই একধরনের অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়ে গেছে। এই দ্বন্দ্বে কে জিতবে বা কে হারবে, তা বলা কঠিন। তবে একটা বিষয় একদম পরিষ্কার, এই যুদ্ধে বড় ভুক্তভোগী কেবল নিরীহ গাজাবাসী।
লেখক: সিএনএনের নিয়মিত কলামিস্ট
সিএনএন থেকে অনুবাদ: সুমৃত খান সুজন