প্রকৃতির নিজস্ব রীতিনীতি রহিয়াছে। এই রীতিনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হইল পরিবর্তন। সময়ের বিবর্তনে আমাদের পৃথিবী বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়া এই পর্যন্ত আসিয়াছে। ৪৫০ কোটি বত্সরের পুরাতন এই পৃথিবীতে মানুষের বসবাস মাত্র আড়াই লক্ষ বত্সর। তাহার পরও স্বীয় বুদ্ধির জোরে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে এই গ্রহে মানুষই একমাত্র প্রাণী হইয়া উঠিয়াছে, যাহারা প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করিয়া ইহার আচরণকে বুঝিতে শিখিয়াছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিকট ভবিষ্যতে প্রকৃতি কেমন আচরণ করিবে—তাহাও বলিতে সক্ষম হইয়াছে; কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক বত্সরগুলিতে প্রকৃতি হঠাত্ বিরূপ আচরণ শুরু করিয়াছে। বিশেষ করিয়া, ২০২১ সালের প্রারম্ভ হইতে সমগ্র বিশ্বের আবহাওয়া হইয়া উঠিয়াছে চঞ্চল। এই মুহূর্তে বিশ্বের বহু দেশের মানুষকে ভয়ংকর দাবদাহে পুড়িতে হইতেছে, কোথাও আবার যুঝিতে হইতেছে অতিরিক্ত বন্যা ও দাবানলের সহিত। আবহাওয়ার এমন চরম আচরণ মূলত মনুষ্যসৃষ্ট।
২০২৩ সাল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের উষ্ণতম বত্সর। চলতি বত্সরের উষ্ণতা গত বত্সরকেও ছাড়াইয়া যাইবে বলিয়া আশঙ্কা করিতেছেন আবহাওয়াবিদরা। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ইতিমধ্যে থার্মোমিটারের পারদ উঠিয়াছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। প্রচণ্ড দাবদাহে সমগ্র দেশের জনজীবন অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে। এইগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল। শিল্পায়নের শুরু হইতেই আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়াইয়া বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের ভারসাম্য নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছি। আমাদের বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত গ্রিনহাউজ গ্যাস ক্রমেই পৃথিবীর জলবায়ুকে উষ্ণ করিয়া তুলিতেছে। কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সূর্যের উত্তাপকে আটাকাইয়া রাখে। সেই উত্তাপ আবার বিশ্বের সকল জায়গায় সমানভাবে ছড়াইয়া পড়িতেছে না, যাহার পরিণতি হইতেছে আবহাওয়ার এমন অস্বাভাবিক ও চরম রূপ। সময়ে অসময়ে দেখা যাইতেছে বন্যা, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশেও বেশ কয়েক বার আঘাত হানিয়াছে। আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করিতেছেন—আগামী বত্সরগুলিতে সমগ্র বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মারাত্মক রূপ ধারণ করিবে। আমাদের দেশের কাঠামো ও মানুষের শক্তিশালী প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করিবার সামর্থ্য বৃদ্ধি পাইলেও জলবায়ুর পরিবর্তনের সহিত পাল্লা দিয়া নিজেদের সক্ষমতাও বৃদ্ধি করিতে হইবে। এই মুহূর্তে অতিরিক্ত দাবদাহে দেশের মানুষ জরাজীর্ণ। ঝড়ের সময় তাপমাত্রা কিছুটা কমিয়া আসিলেও অন্যান্য ভোগান্তি বাড়িয়া যায় বহু গুণে। কালবৈশাখী কিংবা অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যার সময় বাংলাদেশের রাজধানীসহ বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল পানিতে তলাইয়া যায়। ইহার কারণে যাতায়াতব্যবস্থায় ব্যাঘাত তো ঘটেই, তাহার পাশাপাশি অবস্থা আরো বেগতিক হইয়া যায় যখন কোনো বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়িয়া পানিতে পড়ে। ইহার পূর্বেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির সময় বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়িয়া পড়ার কারণে একাধিক মানুষের মৃত্যু হইয়াছে। এই ধরনের দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হইল নজরদারির অভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়িয়া উঠা অবৈধ বৈদ্যুতিক খুঁটি ও মাকড়সার জালের মতো ছড়াইয়া থাকা বৈদ্যুতিক তার। অতিরিক্ত গরমের দিনে এই সকল বৈদ্যুতিক খুঁটিতে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হওয়ার কারণে প্রায়শই অগ্নিকাণ্ড ঘটিতে দেখা যায়। রাজধানী শহরে যত অগ্নিকাণ্ড ঘটে তাহার অধিকাংশই এই সকল বৈদ্যুতিক অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে ঘটিয়া থাকে।
সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবী জুড়িয়া আবহাওয়ার রূপ ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এই ভিন্নতাকে বাড়াইয়া চরম ভাবাপন্ন করিয়া তুলিতেছে জলবায়ু পরিবর্তন। এই মুহূর্তে আমাদের উপর এই বৈরী আবহাওয়ার প্রভাব কমাইয়া আনাটাই শুধু চ্যালেঞ্জ নহে, আমরা ইতিমধ্যে যেই চরম ভাবাপন্ন পরিস্থিতির মুখে পতিত হইয়াছি, তাহার সহিত কীভাবে খাপ খাওয়াইয়া চলা যায়, সেইটাও শিখিতে হইবে। এমন অবস্থায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাইয়া বেশি বেশি বৃক্ষ রোপণ তপ্ত পৃথিবীতে বাঁচিয়া থাকিবার উপায় বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে।