ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষে আমরা এক সম্পাদকীয়তে এইবারের ঈদ যাত্রাকে স্বস্তিদায়ক ও আনন্দময় বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলাম। কেননা এইবার অবকাঠামোগত বিভিন্ন উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্পরতা ও প্রশাসনের সার্বিক তদারকির কারণে ঘরে ফিরা মানুষকে তেমন বেগ পাইতে হয় নাই; কিন্তু যখন কর্মস্থলে ফিরা এখনো অব্যাহত রহিয়াছে, তখন দেশের কোথাও কোথাও বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যাইতেছে। এই সকল খবর অত্যন্ত বেদনাদায়ক। বিশেষত গত মঙ্গলবার ফরিদপুরের সড়কে বাস-পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের পাঁচ জনসহ ১৪ জনের মৃত্যু হইয়াছে। চিকিত্সাধীন চার জন। ইহা ছাড়া গতকাল ইত্তেফাকের অনলাইন খবরে বলা হইয়াছে, ঝালকাঠির গাবখান সেতু এলাকায় প্রাইভেট কার-অটোরিকশায় ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হইয়াছেন ১৪ জন। আহত হইয়াছেন অন্তত ২৫ জন। এই সকল দুর্ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও দুঃখজনক।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পাইবার কোনো লক্ষণই দেখা যাইতেছে না। ইহাকে অনেকে মহামারির সহিতও তুলনা করিয়া থাকেন। আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে যত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হয়, তাহা একটি যুদ্ধেও হয় না; কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা না কমিলেও ইতিমধ্যে আইন সংশোধনপূর্বক শাস্তি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হইয়াছে! সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজারের অধিক মানুষের মৃত্যু হইয়াছে। ইহাতে প্রতিদিন সড়কে মৃত্যু হইয়াছে প্রায় ১৪ জন। যদিও বাংলাদেশ হেলথ ইনজুরি সার্ভে অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। বিআরটিএর তথ্য অপূর্ণাঙ্গ হইলেও সেই হিসাবও যে ভয়াবহ, তাহাতে সন্দেহ নাই।
ঝালকাঠির ঘটনার লাইভ ভিডিও দেখিয়া আমরাও মর্মাহত। উপর্যুক্ত দুইটি দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করিলে দেখা যায়, এই সকলের পিছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাব, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, অনাকাঙ্ক্ষিত গতি, অবহেলা ও অসচেতনতা। যাত্রীদের অসচেতনতাও এইখানে কম দায়ী নহে। এইখানে অবকাঠামোগত ত্রুটিবিচ্যুতির বিষয়টি যেন গৌণ। বিশেষত আলোচ্য প্রথম দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, হাইওয়ে পুলিশ সুপারের বক্তব্য অনুযায়ী ইউনিক পরিবহনের বাসটির ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হইয়াছে ২০২০ সালে। বেশ কয়েকটি মামলাও রহিয়াছে ঐ বাসের বিরুদ্ধে। তাহা হইলে বাসটি গত চার বত্সর ধরিয়া সড়কে চলিতেছে কীভাবে? তাহা ছাড়া পিকআপে যাত্রী পরিবহন সম্পূর্ণ বেআইনি। কীভাবে তাহারা যাত্রী পরিবহন করিতেছিল? ইহা কি কোনো ট্রাফিক পুলিশের নজরে আসে নাই? অতিরিক্ত গতিতে কিংবা তন্দ্রাভাব লইয়া গাড়ি চালানও অপরাধের মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে দ্বিতীয় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, গাবখান সেতু টোল প্লাজায় টাকা দেওয়ার অপেক্ষায় ছিল ইজিবাইক, প্রাইভেট কারসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি। এই সময় পিছনে থাকা সিমেন্টবাহী ট্রাকটি কীভাবে সম্মুখে আসিয়া সকল গাড়িকে ধাক্কা দিল? আমাদের প্রতিনিধির পাঠানো খবর অনুযায়ী এই ট্রাকচালককে গ্রেফতার করা হইয়াছে। তদন্ত সাপেক্ষে আমরা তাহার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করি।
বিভিন্ন আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনায় সংক্ষুব্ধ নাগরিকগণ মানববন্ধনসহ নানাভাবে প্রতিবাদ জানান এবং দোষী ব্যক্তির শাস্তি দাবি করেন। এই সকল দুর্ঘটনায় অনেক সময় সরকারিভাবে তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়; কিন্তু দুঃখজনক হইল, ইহাতেও বেপরোয়া চালকের শাস্তি হয় কদাচিত। আর প্রচলিত আইন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে অনুকূল নহে, তাহা বারংবার প্রমাণিত হইয়াছে। প্রভাবশালী মহলের প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠিয়া সকল নাগরিকের জন্য নিরপেক্ষ ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করিয়া তাহা আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন না করিলে সড়ক দুর্ঘটনার মতো মহামারির অবসান হইবে বলিয়া মনে হয় না। এই জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের প্রবল আন্দোলনের সময় সরকারি সংস্থাগুলো বলিয়াছিল যে, তাহাদের আন্দোলনের কারণে তাহাদের চক্ষু খুলিয়া গিয়াছে; কিন্তু প্রতিদিন এই সকল দুর্ঘটনার খবর পড়িতে পড়িতে যাহারা ক্লান্ত তাহাদের প্রশ্ন, তাহাদের খুলিয়া যাওয়া চক্ষু কি আবার বন্ধ হইয়া গিয়াছে? অতএব, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জাতীয়ভাবে ব্যাপক কর্মসূচি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হউক—ইহাই আমাদের একান্ত কাম্য।