ইরানের নজিরবিহীন ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার পর সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখন ইসরাইলের দিকে। চিরশত্রু ইরান-ইসরাইলের মধ্যে এবারের সংঘাতের শুরুটা হয় চলতি মাসের একেবারে প্রথম দিন তথা ১ এপ্রিল। এদিন সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালায় ইসরাইল। ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন ঐ হামলায়। এর জবাবে গত শনিবার দিবাগত রাতে (১৩ এপ্রিল) ইসরাইলকে লক্ষ্য করে তিন শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)। অবশ্য এসব ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের বেশির ভাগই রুখে দেওয়া হয়েছে বলে ইসরাইল দাবি করেছে।
যাহোক, ইরানের হামলার বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা করতে দফায় দফায় ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। বিভিন্ন সূত্রের বরাতে জানা যাচ্ছে, ইরানে শিগিগরই পালটা হামলা চালানোর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে ইসরাইলের মন্ত্রিসভা। যদিও কখন ও কীভাবে হামলা চালানো হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানা যায়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, ‘সীমিত’ পরিসরে হলেও ইরানে আঘাত হানবে ইসরাইলি বাহিনী। এমনও মনে করা হচ্ছে, সরাসরি ইরানের ভেতরে হামলা চালানো না হলেও বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তেহরানের প্রক্সি গ্রুপগুলো লক্ষ্য করে হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। ইসরাইলি হামলার আশঙ্কায় স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে চলেছে ইরান। ইতিমধ্যে পারমাণবিক স্থাপনা বন্ধ ঘোষণা করেছে তেহরান।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখতে হয়, ইসরাইল পালটা হামলা চালালে গাজা সংঘাতের কারণে আগে থেকেই মহাসংকটে থাকা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল আরো বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। আরো উদ্বেগজনক কথা, কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিভিন্ন পক্ষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততায় গোটা বিশ্ব হয়ে উঠবে উত্তপ্ত। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে ইসরাইলকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। তবে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, ইসরাইল এতে আদৌ কর্ণপাত করবে বলে মনে হয় না। এখন দেখার বিষয়, ইসরাইল কীভাবে ‘প্রতিক্রিয়া’ দেখায়।
মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে সর্বাত্মক সংঘাত এড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্র্রিটেন ও ইসরাইলের অন্যান্য বন্ধু ও মিত্রদের দায়িত্ব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের বক্তব্য, এসব পক্ষের উচিত হবে নেতানিয়াহুকে স্পষ্ট ভাষায় জানানো যে, সামরিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখার স্বার্থে ইসরাইলকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে ইরানে পালটা আঘাত না করলেই ভালো হবে তেল আবিবের জন্য।
হামলার পর খোদ ইসরাইলের পক্ষ থেকে বলা হয়, মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়নি ইরানি হামলায়। হামলার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে তেহরান। ইসরাইলের দাবি, ৯৯ থাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে। একে সৌভাগ্যই বলতে হয়। অন্যদিকে, তেহরান জানিয়েছে, হামলা-আত্রমণের পর্ব আপাতত ‘সমাপ্ত’। তবে ইসরাইলের পক্ষ থেকে পালটা আক্রমণ এলে নতুন করে হামলার কথা ভাবা হবে। সমস্যা মূলত এখানেই। উভয় পক্ষের হামলা ও পালটা হামলায় অস্থিরতা কেবল বাড়তেই থাকবে।
এই যখন অবস্থা, তখন নেতানিয়াহুর জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে বিশ্লেষকদের আহ্বান আমলে নেওয়া ‘মাথা ঠান্ডা রাখা’। এর ফলে তিনি বিশ্বের সামনে এটা প্রমাণ করতে পারবেন যে, ‘ইরান একটি বিপজ্জনক, দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইরান যে হামলা চালিয়েছে, তার ফলে ইসরাইল, আরব ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কট্টরপন্থি নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি নিজের আসল রং দেখিয়েছেন। ফলে তেহরানের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’ ইরানকে বেকায়দায় ফেলতে নেতানিয়াহুর হাতে এখন এই যুক্তিও আছে।
ইরানের হামলাকে নেতানিয়াহুর জন্য শাপে বর বলে অভিহিত করছেন অনেকে। কারণ, তেহরানের হামলার পর বিশ্বের মনোযোগ গাজা থেকে কিছুটা হলেও সরে যাবে। এতে করে গাজা যুদ্ধে নেতানিয়াহু সরকারের ব্যর্থতা চাপা পড়ে যেতে থাকবে। আরেকটি বিষয়, হামাসকে পরাজিত করার যে মিশন হাতে নিয়ে এগোচ্ছিলেন নেতানিয়াহু, তাতে তিনি স্পষ্টত ব্যর্থ। ইরানের হামলার পর এই ব্যর্থতাও কাটিয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হবে তার সামনে! তিনি এখন দাবি খাড়া করার যুক্তি খুঁজে পেয়েছেন যে, হামাসের বিরুদ্ধে সবার একসঙ্গে যুদ্ধ করার বিকল্প নেই।
মনে রাখতে হবে, ইরান বারবার অভিযোগ করে আসছে, বিগত এক দশক ধরে ইসরাইলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ধারাবাহিক আক্রমণের শিকার হচ্ছে তেহরান। গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েক দফা। ইরানের অনেক পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে ইসরাইল হত্যা করেছে। এসবের পাশাপাশি ইরানের আঞ্চলিক প্রক্সি মিলিশিয়া নেতাদের হত্যাও নিয়মিত হয়ে উঠেছে বলে তেহরানের দাবি। বিশেষ করে গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলি ভূখণ্ডে হামাসের হামলার পর থেকে ইরানকে লক্ষ্য করে হামলা ও হত্যার ঘটনা বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডিসেম্বরে দামেস্কে ইরানের সিনিয়র জেনারেল সাইয়েদ রাজি মুসাভিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
লক্ষণীয়, এসবের প্রতিক্রিয়ায় খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছিল তেহরান। ইরানের প্রতিক্রিয়া সব সময়ই তুলনামূলক ‘সীমিত ও পরোক্ষ’। তবে ১ এপ্রিল সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে বোমা হামলার ঘটনায় নড়েচড়ে বসে ইরান। ঐ হামলায় বেশ কয়েকজন সিনিয়র কমান্ডার নিহত হলে স্বভাবসুলভ ধীরগতির প্রতিক্রিয়া থেকে বেরিয়ে এসে ‘গতিশীল প্রতিক্রিয়া’ প্রদর্শনের পথ ধরে খামেনি প্রশাসন। খামেনি এক মন্তব্যে বলেন, ‘ইসরাইল রেড লাইন অতিক্রম করেছে।’ ঠিক এর পরপরই ইসরাইলে হামলা চালিয়ে বসে তেহরান।
একটা বিষয় লক্ষ করার মতো। দামেস্কে হামলার বিষয়ে স্পষ্টতই মার্কিন মিত্রকে আগে থেকে অবহিত করেননি নেতানিয়াহু। এর সম্ভাব্য কারণ, বাইডেন প্রশাসন এতে ভেটো দেওয়ার চেষ্টা করত নিশ্চিতভাবে। আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে স্বাভাবিকভাবেই কোনো পরাশক্তির সঙ্গে নতুন ঝামেলায় জড়াতে চাইবেন না বাইডেন। বলা যায়, দামেস্ক দূতাবাসে নেতানিয়াহু হামলা চালিয়েছেন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার চিন্তা থেকেই। আমরা জানি, অনেক দিন ধরেই দেশের ভেতরে বড় ধরনের সমালোচনা চলছে নেতানিয়াহুকে নিয়ে। গাজা যুদ্ধ বন্ধে তার ওপর চাপ আছে আমেরিকানদের পক্ষ থেকে। এমনকি ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপও ক্রমশ বাড়ছিল। ঠিক এমন একটি অবস্থায় দামেস্কে হামলার পথে হাঁটেন নেতানিয়াহু। তিনি সম্ভবত মনে করে থাকতে পারেন, এতে করে তার বিরুদ্ধে দানা বাধা সমালোচনা বন্ধ হবে। যাহোক, নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা কতটা কাজে দেবে, তা জানা যাবে খুব তাড়াতাড়িই।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, বিভিন্ন প্রক্সি গ্রুপকে আড়াল থেকে সমর্থন করে আসছিল ইরান। তবে ইসরাইলের দামেস্ক হামলা এবং এর জবাবে ইসরাইলি ভূখণ্ডে তেহরানের পালটা হামলার পর পুরোপুরি সামনে চলে এসেছে তেহরান। ইরান এখন আর ছায়াযুদ্ধে নয়, বরং সরাসরি সংঘাতের ময়দানে।
এদিক থেকে দেখলে নেতানিয়াহুর কৌশল বেশ কাজে দিয়েছে বলতে হয়। গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর বিষয়ে নেতানিয়াহুকে নিয়ে ওয়াশিংটনের সমালোচনা অনেকটাই কমে গেছে রাতারাতি! একই কথা প্রযোজ্য ব্রিটেনের ক্ষেত্রেও। অন্যদিকে, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিদের মতো প্রক্সি বাহিনীগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকা তেহরানের নেতাদের জন্য খুব একটা সহজ হবে না আগামী দিনগুলোতে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, একটা জায়গায় বড় ধরনের ভুল করে ফেলেছে ইরান। দামেস্কে হামলার পর জাতিসংঘ ও হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ জানাতে পারত তেহরান। উপরন্তু জি-২০ ও ব্রিকস মিত্রদের মাধ্যমে বিষয়টি সামনে এগিয়ে নিতে পারত। এর ফলে কী হতো? বৈশ্বিক দক্ষিণ (গ্লোবাল সাউথ উন্নয়নশীল বিশ্ব) এবং চীন ও রাশিয়ার মতো পশ্চিমাবিরোধী মিত্রদের সহানুভূতি অর্জন করতে পারত তেহরান। কিন্তু তা না করে সরাসরি নেতানিয়াহুর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন খামেনি! একইভাবে ইসরাইল যদি তড়িঘড়ি করে পালটা হামলা চালিয়ে বসে ইরানে, বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা ভালোভাবে না-ও নিতে পারে। বরং তাতে করে সিরিয়া, লেবাননসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্য ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মুখে পড়ে যাবে। আরো রক্তপাত, আরো দুর্দশা ছড়িয়ে পড়বে। এমন একটি প্রেক্ষাপটে সংকট নিরসনে পক্ষগুলোর একসঙ্গে গঠনমূলক কাজ করার বিকল্প নেই। অন্যথায় এক ভয়ানক, অজানা পরিণতি অপেক্ষা করছে মধ্যপ্রাচ্যের সামনে।
লেখক:পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ও নিয়মিত কলামিস্ট
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ: সুমৃত খান সুজন