জীবনে চলিতে-ফিরিতে আমরা প্রায়শই দেখিতে পাই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অসচেতন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কার্যকলাপ। সাধারণ মানুষ হইতে শুরু করিয়া সমাজের কথিত শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত মানুষও হরহামেশা দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড করিয়া বসেন। উদ্বেগের বিষয় হইল—আমাদের দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষের মধ্যে বিরাজ করিতেছে অসাবধানতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। এই সমস্ত লোকের মধ্যে কেহ কেহ নিতান্তই নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন, আবার কেহ কেহ সীমা লঙ্ঘন করিয়া এমন কার্যসাধন করিয়া বসেন যাহা দেশ ও দেশের জনগণের জন্য হুমকি হিসাবে আবির্ভূত হইতে পারে। ব্যক্তিগত জীবন হইতে শুরু করিয়া জাতীয় জীবনে বিরাজমান এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কখনো কখনো নিজের জন্য আত্মঘাতী হইয়া উঠে। এমনই এক ঘটনার সাক্ষী হইয়া নিজের চাকুরি হারাইয়াছেন খুলনা রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়ের একজন পুলিশ সুপার।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ঢাকায় স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রোটেকশন ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসাবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি এক বহিরাগতকে পুলিশের অস্ত্রাগার পরিদর্শন করান। এমনকি ঐ বহিরাগতকে বিভিন্ন অস্ত্রের বর্ণনা দিয়া ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করিবার সুযোগ করিয়া দিয়াছিলেন। একজন দায়িত্বশীল পুলিশের কর্মকর্তা কোনোভাবেই সাধারণ মানুষকে পুলিশের অস্ত্রাগারে প্রবেশের অনুমতি দিতে পারেন না। অস্ত্রের বর্ণনা ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করিবার কোনো প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশ পুলিশের নিকট কোন ধরনের অস্ত্র রহিয়াছে এবং কোন অস্ত্র কীভাবে কাজ করে তাহা পুলিশে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাহিরে অন্য কাউকে জানানো সমীচীন নহে। পুলিশের ব্যবহার্য অস্ত্রের জ্ঞান বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠী দেশ ও দশের ক্ষতির জন্য ব্যবহার করিতে পারে। যদিও শাস্তিস্বরূপ ঐ পুলিশ কর্মকর্তা চাকুরিচ্যুত হইয়াছেন; কিন্তু একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট হইতে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ মোটেও কাম্য নহে।
অসচেতনতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার এমন উদাহরণ আমাদের সমাজে ভূরিভূরি রহিয়াছে। একদিকে সাধারণ মানুষের অসচেতনতা, অন্যদিকে দায়িত্বশীল মানুষের উদাসীনতা—উভয় ক্ষেত্রেই যেন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রতিযোগিতা চলিতেছে। সিগন্যাল ও ট্র্যাফিক আইন না মানিয়া, ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করিয়া রাস্তা পার হইতে গিয়া অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হইতেছেন। আবার তরুণরা ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম রিলসে নিজেদের দাপট জাহির করার জন্য বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাইতে গিয়া অকালে মৃত্যুবরণ করিতেছে। অনেক সময় উচ্চগতিসম্পন্ন এই সমস্ত মোটরসাইকেলের সহিত রাস্তার সাধারণ পথচারীদের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটিয়া থাকে। কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটিলে সেইখানেও প্রকাশ পাইতেছে কর্তৃপক্ষের অবহেলা কিংবা যথাযথ তদারকির অভাব। সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাহারা তাহাদের দায়িত্বই যেন ভুলিয়া যাইতেছেন। অথচ সুন্দর ও নিরাপদ জীবনযাপনে আমাদের স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যজ্ঞান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা আবশ্যক। ইহা রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। অনেক সময় দেখা যায়, রাজনীতিবিদদের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য ও দায়সারা মন্তব্যের কারণে বিভিন্ন স্থানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইতেছে।
আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে—সর্বত্র বিরাজমান এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আমাদের আশাহত না করিয়া পারে না। যাহারা কোনো কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত তাহারা যদি কর্তব্যের অবহেলা করে বা উদাসীনতা দেখাইয়া ফেলিয়া রাখে, তাহা ক্রমশই বর্তমান অবস্থাকে জটিল করিয়া তোলে। ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ—সমস্ত ক্ষেত্রে সকলের নিকট দায়িত্বশীল আচরণ কাম্য। সমাজে নিজের প্রভাব যত বর্ধিত হইবে, সমাজের প্রতি নিজের দায়িত্বও তত বৃদ্ধি পাইবে। আমাদের মনে রাখিতে হইবে, মানুষের ক্ষমতার মাত্রা যতটা বিশাল, দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিধি ততটাই বিস্তৃত।