মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

আন্তর্জাতিক মা ধরিত্রী দিবস

আমরা কি মা ধরিত্রীর ধ্বংস ডেকে আনছি?

আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩০

মানুষসহ সব প্রাণের বেঁচে থাকা পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল—এই গ্রহ মায়ের মমতায় সবাইকে মাটি-পানি-বায়ু দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রধানত শিল্পবিপ্লব শুরুর লগ্ন থেকে মানুষ এই গ্রহের ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে আসছে, পৃথিবী নামের মায়ের ক্ষতি করে আসছে, যা মানুষসহ গ্রহের বাসিন্দাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে উঠেছে। নিজের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও সীমাহীন অভিলাষ পূরণ ছাড়াও শক্তিমত্তার জন্য সম্পদ আহরণ করতে গ্রহের ভূদৃশ্য বদলে দিচ্ছে। ভূ-উপরিস্থ মাটি-পলি অপসারণ, খাদ্যের জন্য বন ও অনাবাদি জমিকে কষিভূমিতে রূপান্তর, নগরায়ণ-অবকাঠামো ও যোগাযোগ উন্নয়ন, এমনকি পাহাড় কেটে, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে বাঁধ নির্মাণ, বেআইনি বন্যপ্রাণী-বাণিজ্য করছে, ঘটছে মাটি-পানি-বাতাসের দূষণ। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে ঘটছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন, পরিণতিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। এমনকি মহাকাশও বাদ যায়নি; কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস উপশমে বিঘ্ন, মত্স্যসংখ্যা হ্রাস ও ইকোসিস্টেমে নেতিবাচক প্রভাবের তীব্র ঝুঁকির আশঙ্কা এবং বহু প্রতিবাদ সত্ত্বেও কিছু দেশ মহাসাগরের গভীর তল থেকে ধাতব খনিজ আহরণের লক্ষ্যে এগোচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে পৃথিবী ও এর বাসিন্দাদের কল্যাণের লক্ষ্যে বৈশ্বিকভাবে সচেতন করতে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবছর ২২ এপ্রিল আন্তর্জাতিক মা ধরিত্রী দিবস পালন করা হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘গ্রহ বনাম প্লাস্টিক’। কোথায় নেই প্লাস্টিকের উপস্থিতি—মাটি, পানি, বায়ু, খাদ্য, সাগরতল। এমনকি মানুষের রক্ত ছাড়িয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন মাতৃজঠরে হাজির, নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় মানব প্লাসেন্টার ৬২টি নমুনার প্রতিটিতেই পাওয়া গেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন ঊর্ধ্বাকাশের মেঘের মাঝেও উপস্থিত, যা মেঘ সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলতে পারে, প্রভাব ফেলবে বৈশ্বিক আবহাওয়া রীতি ও তাপমাত্রায়—গার্ডিয়ানে প্রকাশিত নিবন্ধে বিজ্ঞানীগণ বলছেন। মানুষই প্লাস্টিক ব্যবহারকারী একমাত্র প্রাণী এবং এটি পৃথিবীর সবকিছু দূষিত করে সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং বিপর্যয় ডেকে আনছে। কাজেই এ বছরের প্রতিপাদ্য যথার্থ হয়েছে, সম্মিলিত প্রয়াসে প্লাস্টিক থেকে মুক্তির উপায় বের করতে হবে।

এই গ্রহের ৪০ শতাংশ বা ৫ বিলিয়ন হেক্টর ভূমি কৃষিকাজে ব্যবহূত হয়, এক-তৃতীয়াংশ ফসল উত্পাদনে ও অবশিষ্ট পশুচারণে। বিগত ৫০০ বছরে দুই বিলিয়ন হেক্টর ভূমির অবক্ষয় ঘটেছে—মূলত নিবিড় কৃষি ও পশুচারণ, আবাসন উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। মাটিতে বিশৃঙ্খলা ঘটায় প্রায় ১২৫ বিলিয়ন টন গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণ ঘটে। পরিণতিতে বৈশ্বিক উঞ্চায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং ২০৫০ সালের মধ্যে আরো ১২০ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসারিত হতে পারে। খাদ্যের বৈশ্বিক চাহিদা ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা ৩০ শতাংশে হ্রাস পেতে পারে। বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী কংক্রিটের ব্যবহার এতটাই বেড়েছে যে, ব্যবহূত কংক্রিট দিয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠকে দুই মিলিমিটার পুরু আবরণে ঢেকে দেওয়া যাবে। ওয়ার্ল্ড ফরেস্ট ওয়াচের সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি মিনিটে ১০টি ফুটবল মাঠের সমপরিমাণ বনভূমি হারাচ্ছে বিশ্ব এবং গত দুই দশকে গড়ে ৭.৪ শতাংশ বনভূমি হারিয়েছে এবং বাংলাদেশ হারিয়েছে ৮.৭ শতাংশ (৮০৩৯ হেক্টর)। তবে দেশে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার হেক্টর বনভূমি পুনরুদ্ধার হয়েছে। ২০২৩ সালে ৩.৭ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি হারিয়েছে পৃথিবী, বনভূমি সংকোচন গ্রহটিকে মানুষের জন্য বসবাস অযোগ্য করে তুলবে।

বৈশ্বিক পরিসরে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকসহ ভূ-উত্সজাত অন্যান্য দূষণ ভূপ্রকৃতি, আবহাওয়া ও মানবীয় কর্মকাণ্ড ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়। এতে ৩০-৫০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্য এমনকি অকালমৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে এবং আর্সেনিক দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৪০ হাজার অকালমৃত্যুর আশঙ্কা আছে বলে এক গবেষণায় এসেছে। জাতিসংঘের পানি প্রতিবেদন ২০২২ বলছে, বাংলাদেশের ৫৯ শতাংশ মানুষ নিরাপদ উত্স থেকে সুপেয় পানি পায়।

এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সে ২০২২ সালের গবেষণা বলছে, বিশ্বের ৯৩.৩ শতাংশ জনসংখ্যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃত গাইডলাইন (২.৫ প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম গাঢ়ত্ব) ছাড়িয়ে উন্মুক্ত ছিল। ২০২৩ সালে ঐ আকারের কণার বার্ষিক গড় গাঢ়ত্ব ৭৯.৯ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সবার ওপরে। এসব সূক্ষ্ম কণা ফুসফুসের গভীরে পৌঁছে স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি ও গড় আয়ু হ্রাস করতে সক্ষম।

আলো ও তাপমাত্রার সম্পর্কে উদ্ভিদ ও বেশির ভাগ ইকোসিস্টেমের মাটির মধ্যে একধরনের সমন্বয় থাকে। জলবায়ু পরিবর্তন ঋতুচক্রে পরির্বতন এনেছে, ঋতুর সামান্য সরে যাওয়াকে মানুষ উপলব্ধি করতে না পারলেও উদ্ভিদ সহজেই শনাক্ত করতে পারে এবং বদলায়। বড় মাপের বিচ্ছিন্নতা এনেছে উদ্ভিদ ও প্রাণজিগতের হাজার হাজার বছরের যোগাযোগব্যবস্থায়, এভাবে পুরো ইকোসিস্টেম ভুগছে। বায়ুর বর্ধিষ্ণু তাপমাত্রা শীতকালকে সংক্ষিপ্ত ও মৃদু করেছে। এলনিনোর প্রভাবে ক্যারিবিয়ান, বঙ্গোপসাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, আলাস্কা ও আমাজনের অংশবিশেষে চলতি বছর তীব্র গরম পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা শিশু ও বয়স্কসহ সব বয়সি মানুষের স্বাস্থ্য (কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, মস্তিস্ক, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ; মানসিক, উচ্চ রক্তচাপ), মত্স্য, প্রবাল তথা সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমের জন্য ক্ষতিকর ও দাবানল বৃদ্ধি করবে বলে মত ব্যক্ত করেছেন নোয়া প্যাসিফিক মেরিন এনভায়রনমেন্ট ল্যাবরেটরির ম্যাকফ্যাডেন। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৯৭ শতাংশ মত্স্য বিলুপ্তির হুমকিতে এবং বিশ্বের মোট পরিযায়ী প্রজাতির প্রায় অর্ধেকসংখ্যক হ্রাসের ঝুঁকিতে আছে। ঢাকা শহরে নির্মাণকাজ ও গাড়ির শব্দে একদা শ্রুত কাকের ডাক এখন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে, কাক এখন ধীরলয়ে বিলুপ্তির পথে।

মহাকাশে ব্যবহূত মানবসৃষ্ট বস্তু কার্যক্ষমতা হারিয়ে মহাকাশ ধ্বংসাবশেষ বা আবর্জনা একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হিসেবে এবং মহাশূন্য অনুসন্ধান ও মানুষের নিরাপত্তার জন্য বৈশ্বিক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির ২০২২ সালের হিসাবে এক সেন্টিমিটারের বড় আকারের ধ্বংসাবশেষের প্রায় ১০ লাখ টুকরো অনুচ্চ কক্ষপথে প্রতি ঘণ্টায় ২৮ হাজার থেকে ২৯ হাজার কিলোমিটার গতিতে ভেসে বেড়াচ্ছে। তদুপরি গমনপথ অনুসরণ করতে না পারা মহাকাশ আবর্জনার ১০০ ট্রিলিয়নের বেশি এমন টুকরোও অনুচ্চ কক্ষপথে রয়েছে। মজার বিষয় হলো, বিপজ্জনক এসব জঞ্জাল পরীক্ষণের জন্য জাপান সম্প্রতি আরেকটি মহাকাশযান উেক্ষপণ করেছে।

বিজ্ঞানীগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, ২০২৩ সালটি ছিল সবচেয়ে উত্তপ্ত বছর এবং চলতি বছরটি আরো উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনে ভারসাম্য পুনরায় ফিরিয়ে আনার প্রত্যক্ষ ও বৃহত্ পরিসরের উদেযাগের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা অনেকটা এগিয়েছে, যাকে জিয়ো ইঞ্জিনিয়ারিং বলে। এটা মূলত দুই ধরনের—কার্বন জিয়ো ইঞ্জিনিয়ারিং, অর্থাত্ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন অপসারণ এবং সৌর জিয়ো ইঞ্জিনিয়ারিং। অর্থাত্, এই গ্রহের শীতলীকরণে সহায়তায় সূর্যরশ্মির কিছু অংশকে পৃথিবীতে প্রবেশে বাধা প্রদান। তবে দুটোই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, ইতিমধ্যে তীব্রভাবে বিঘ্নিত জলবায়ুব্যবস্থাকে এমন জিয়ো ইঞ্জিনিয়ারিং বাস্তবে আরো অস্থিতিশীল করার ঝুঁকি রয়েছে। গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসারণকে শূন্যে নামিয়ে আনার চলমান কাজে বিচ্যুতি ঘটিয়ে জিয়ো ইঞ্জিনীয়ারিং আরো একটা বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তবে আশার কথা, গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক ষষ্ঠ অ্যাসেম্বিলিতে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিগণ এতত্সংক্রান্ত প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ প্রত্নসম্পদ ধারণকারী পলি ও মাটির ভৌত ও ভূপ্রকৌশল গুণাগুণে প্রভাব ফেলবে, পরোক্ষভাবে দীর্ঘ মেয়াদে যার স্থায়ী প্রভাব প্রত্ন স্থাপনায় পড়বে বলে মত দেওয়া যায়। তবে এ ব্যাপারে গবেষণা প্রয়োজন, ‘লস্ অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’-এর সহায়তায় হতে পারে, গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাব থেকে প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে।

মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উঞ্চায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবীয় অন্যান্য কর্মকাণ্ড এই গ্রহের মাটি-পানি-বায়ু-মহাশূন্য-সাগরতল-জীববৈচিত্র্যকে সংকটে ফেলেছে, মানুষসহ সবাইকে বিপর্যস্ত করেছে, সবার ধ্বংস ডেকে আনছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান এককভাবে কোনো দেশের পক্ষে সম্ভব নয়, সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। তাত্পর্যপূর্ণ যে, সমস্যার প্রায়োগিক সমাধানের জন্য স্থানীয় অভিজ্ঞতা ও পরিপ্রেক্ষিত সমন্বয়ে নানা ক্ষেত্রে গবেষণায় আমাদের জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে, লব্ধ ফলাফল বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানেও অবদান রাখতে পারবে।

লেখক: ভূতত্ত্ববিদ ও গবেষক

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন