আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দর হিসাবে পরিচিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাঁকজমকপূর্ণ শহর দুবাইয়ের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। গত সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বিলাসবহুল এই শহরটি নজিরবিহীন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হইয়াছিল। দুবাইয়ের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, মাত্র ২৪ ঘণ্টায় যেই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হইয়াছে, তাহা সাধারণত দেড় বছরের বৃষ্টিপাতের সমান। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতজনিত কারণে দুবাইয়ের রাস্তার গাড়ি, বিমানবন্দরের বিমান বানের পানিতে ভাসিতেছিল। মরুভূমির শহরে হঠাত্ এত বৃষ্টি শুধু দুবাইয়ের বাসিন্দাদের দুর্ভোগের কারণ হয় নাই, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হইয়াছিল, আটকাইয়া গিয়াছিল হাজার হাজার পর্যটক। দুবাইয়ের এই সমস্যা শুধু নজিরবিহীন বৃষ্টিপাতই নহে, মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়াছিল বহুগুণে, কারণ মরুর শহর দুবাই বালুঝড়ের জন্য প্রস্তুত থাকিলেও অতিবৃষ্টি ও বন্যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু দুবাই নহে, প্রকৃতির অচেনা রূপ দেখিতে শুরু করিয়াছে সারা বিশ্ব। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, প্রকৃতির এমন খামখেয়ালি আচরণ মোকাবিলা করিবার জন্য আমরা নিজেদের কতখানি প্রস্তুত করিতে পারিয়াছি? তাহার চাইতেও বড় কথা, আমরা কি জানি কখন কী রকম অভাবনীয় দুর্যোগময় আচরণ করিবে প্রকৃতি?
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৯২ সালে ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) যাত্রার মাধ্যমে। ইহার পর অগণিত বৈঠক হইয়াছে, স্বাক্ষরিত হইয়াছে বিভিন্ন চুক্তিপত্র। গ্রিনহাইজ গ্যাস নির্গমনে লিমিট বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমাদের ধরিত্রীর অপূরণীয় ক্ষতি হইয়া গিয়াছে। প্রকৃতির বৈরী আচরণ নিয়ন্ত্রণে আমরা সফলতার মুখ দেখিতে ব্যর্থ হইয়াছি। এই মুহূর্তে আমাদের কর্মফলের ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেদের অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সহিষ্ণুতা শক্তিশালী করিবার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের চেষ্টা চলিতেছে। ইহার পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সহায়তা করিতে বিশ্বের ধনী দেশগুলি ১০০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিল গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল। যদিও, প্রতিশ্রুত জলবায়ু তহবিল আজও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নাই। তবে বিশ্বকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করিতে একে-অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাইবার চেষ্টা শোভন নহে। ব্লেইম-গেম কখনো সমাধান দেয় না। বরং যাহার যাহার অবস্থান হইতে সক্ষমতা অনুযায়ী এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করিতে হইবে।
গত সোমবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবায়ু অভিযোজন সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাহার বক্তৃতায় উন্নত দেশগুলিকে যুদ্ধের পিছনে ব্যয় না করিয়া সেই অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলার জন্য জলবায়ু তহবিলে জমা করিবার আহ্বান জানাইয়াছেন। যে কোনো ধরনের যুদ্ধ প্রাণিকুল ও পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে যুদ্ধ নহে, বরং আমাদের ধরিত্রী সংরক্ষণে ব্যয় করা শ্রেয়—এই কথা ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করিবেন। বিশ্বের সকল সচেতন মহলের ধারণা—ভবিষ্যতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে করোনা মহামারির চাইতে জলবায়ু পরিবর্তন আরো ভয়ংকর প্রভাব ফেলিবে। ইহা হইতে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সময়ক্ষেপণের কোনো সুযোগ নাই।
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। ইহার ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা করিতে বিশ্বের সকল দেশকে একসঙ্গে কাজ করিবার প্রয়োজন রহিয়াছে। দীর্ঘদিন ধরিয়া জলবায়ু পরিবর্তন সমগ্র বিশ্বের সমস্যা হইলেও বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলি ইহার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করিতেছে সবচাইতে বেশি। তাই জলবায়ু সংকট দূরীকরণে দরিদ্র দেশগুলির উন্নত বিশ্বের সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুবাই আমাদের দেখাইয়া দিয়াছে, অকস্মাত্ ও অচিন্তনীয় দুর্যোগ পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যখন-তখন ঘটিতে পারে। দুবাইয়ের ঘটনা হইতে আমাদেরও শিক্ষা লইতে হইবে।