ইউক্রেনের সন্নিকটে পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়ার নির্দেশ দিয়াছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনের আশপাশে অবস্থানরত নৌবাহিনীর সদস্য ও অন্য সেনারা অংশগ্রহণ করিবেন এই মহড়ায়। গতকাল রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এই মহড়া চলাকালে কৌশলগত নহে—এমন (নন-স্ট্র্যাটেজিক) পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রস্তুতিমূলক অনুশীলন করা হইবে। ‘স্ট্র্যাটেজিক’ ও ‘নন-স্ট্র্যাটেজিক’ বা ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রের পার্থক্য মূলত ইহার আকার এবং লক্ষ্যবস্তুতে। ইহার ওয়ারহেড তুলনামূলক ক্ষুদ্র ও কম শক্তিশালী। জনবহুল এলাকার পরিবর্তে যুদ্ধক্ষেত্রের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানিতে ব্যবহার করা হয়।
ভ্লাদিমির পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি নূতন নহে। ইউক্রেনে সংঘাত শুরু হইবার পর হইতেই তিনি এই ব্যাপারে হুমকি-ধমকি দিয়া আসিতেছেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে পারমাণবিক যুদ্ধের ‘বাস্তব’ ঝুঁঁকির বিষয়ে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তবে এই হুমকিতে কাজ হইতেছে না, এমনটি নহে। এই ব্যাপারে পশ্চিমা নেতারা উদ্বিগ্ন। পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিষিদ্ধে সই হওয়া একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি হইতে গত বত্সর রাশিয়া সরিয়া আসিবার পর হইতেই তাহাদের মধ্যে দেখা দিয়াছে আতঙ্ক। ইতিমধ্যে ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী গুইদো ক্রসেত্তো ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ অবসানে পুতিনের সহিত আলোচনার মাধ্যমে কূটনৈতিক সমাধান খুঁজিয়া বাহির করিতে জোর প্রচেষ্টা চালাইবার জন্য পশ্চিমা দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। রাশিয়ার এই হুমকিতে ইউরোপীয় দেশগুলির ভয় পাওয়ার বাস্তবসম্মত কারণ রহিয়াছে। কেননা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও রুশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের স্ট্রাইকিং রেঞ্জ ইউরোপীয় দেশগুলির জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করিয়া, ইউক্রেন ফ্রান্সের সীমান্ত হইতে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার (প্রায় ৯৩২ মাইল) দূরে অবস্থিত। যদি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে জিতিয়া যায়, তাহা হইলে রোমানিয়া, পোলান্ড, লিথুয়ানিয়া বা ফ্রান্সের নিরাপত্তা বিপন্ন হইতে লাগিবে মাত্র এক সেকেন্ড। রুশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তি ও আঘাতের দূরত্ব বিবেচনায় নিলেও ইউরোপের অন্তরে কাঁপুনি সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট।
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করিয়া তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা পারমাণবিক যুদ্ধের সূত্রপাত হইবে কি না, বলা মুশকিল। তবে এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক নহে। ইউক্রেন এখন সরাসরি রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা চালাইতেছে। কিছুদিন পূর্বে রাশিয়ার বেলগোরোদ অঞ্চলে ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় ছয় জন নিহত ও ৩৫ জন আহত হইয়াছেন। ফলে ক্রমেই বাড়িতেছে অস্থিরতা ও উত্তেজনা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ইউক্রেন সফরও তাত্পর্যবহ। সেইখানে সরাসরি ফরাসি সেনা পাঠানো হইলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তাহা বলা কঠিন। ইহাতে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়াইয়া পড়িতে পারে। এখন টেনশনের কারণে নার্ভ শক্ত করিয়া ধরিয়া রাখিতে না পারিয়া পরমাণুশক্তিসম্পন্ন কোনো পাগলাটে শাসক যদি শেষ পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্রের ট্রিগারে চাপ দিয়া বসেন, তাহা হইলে পৃথিবী সমূহবিপদ ও ক্ষতির সম্মুখীন হইবে নিঃসন্দেহে।
বর্তমানে বিশ্বের আটটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। দেশগুলি হইল—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া। ইহার মধ্যে তিনটি দেশ ন্যাটো সদস্য—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। ইহা ছাড়া ইসরাইলের নিকট পারমাণবিক অস্ত্র রহিয়াছে বলিয়া ধারণা করা হয়। আর ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ভাগাভাগি রাষ্ট্র হইল—বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, তুরস্ক ও বেলারুশ। উল্লেখ্য, সাবেক পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী দক্ষিণ আফ্রিকা পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ চুক্তি তথা এনপিটিতে যোগদানের পূর্বে এই অস্ত্রাগার ধ্বংস করে এবং সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র বেলারুশ, কাজাখস্তান ও ইউক্রেন তাহাদের পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ায় স্থানান্তর করে। স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ধারণা, জানুয়ারি, ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী পারমাণবিক রাষ্ট্রসমূহের পারমাণবিক ওয়ারহেডের সংখ্যা ১২ হাজার ৫১২। এইভাবে পরমাণু অস্ত্র দেশে দেশে ছড়াইয়া পড়িবার কারণে অনেকে মনে করেন, এই অস্ত্র এখন অকার্যকর; কিন্তু সীমিত পর্যায়ে ও নন-স্ট্র্যাটেজিক পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োগও যদি শুরু হয়, তাহা হইলে তাহার শেষ পরিণতি কতটা ভয়াবহ হইবে তাহা কল্পনাতীত। অতএব, পরমাণু অস্ত্র লইয়া হুমকি-ধমকি বন্ধ করিতে বিশ্বনেতাদের বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হইবে।