‘আমার এ ঘর বহু যতন করে/ ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।’ ইহা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের দুইটি লাইন। মানুষের যখন ঘর থাকে তখন সেই ঘরে দিনে দিনে ধুলোময়লাও পড়ে। এখন কোনো গৃহকর্তা যদি অনেক দিন পর তাহার চতুষ্পার্শ্বের কোনায় কোনায় খোঁজখবর লইবার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে তিনি দেখিবেন যে, যেইখানে তিনি হাত দিতেছেন সেইখানেই সমস্যা। সেই যে প্রবাদ রহিয়াছে—সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা? চারিদিকে কেবল সমস্যা, সমস্যা আর সমস্যা। সমস্যা নিরসনে সুবেহ সাদেকে উঠিয়া গৃহকর্তা যদি আবর্জনার পরিমাপ বুঝিতে চেষ্টা করেন, তাহা হইলে এক পর্যায়ে তাহার মাথা মরুতপ্ত উষ্ণ দিনের মতো ক্রমশ গরম হইতে হইবে। ঊর্ধ্বমুখে চড়িতে থাকিবে পারদ। তাহার পর, তিনি যদি বুদ্ধিমান হন, তাহা হইলে তিনি বুঝিবেন—এই তপ্ত মাথায় কোনো সমাধান তো আসিবেই না, বরং সমস্যার স্তূপে চাপা পড়িয়া তাহার ব্রেইন স্ট্রোক হইয়া যাইতে পারে। কেহ কেহ হঠাত্ রাগিয়া এমনই অস্থির হইয়া পড়েন যেন পারিলে তিনি পৃথিবীটাকেই ওলটপালট করিয়া দিবেন। মাথা গরমে কাহার ক্ষতি হয় বলা মুশকিল, তবে যিনি রাগেন, ক্ষতিটা তাহারই সবচাইতে বেশি হয়। সুতরাং মাথা ঠান্ডা রাখিবার কোনো বিকল্প নাই। কারণ, সমস্যার সমাধান কখনো তপ্ত মাথায় আসে না, আসে ঠান্ডা মাথায়। সমস্যা সমাধানের জন্য হইলেও মাথা ঠান্ডা রাখিতে হইবে। ইংরেজিতে ইহাকে বলা হয়—পিস অব মাইন্ড ইজ এ মেন্টাল স্টেট অব কামনেস অর ট্রাংকুয়িলিটি। ইহা হইল উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা হইতে মুক্তি পাওয়া।
কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা হইতে মুক্তি পাইতে হইলে নির্জন বনে গিয়া বসবাস করিতে হইবে। আরণ্যিক যুগের সেই অরণ্যও নাই, সেই নির্জনতাও নাই। আমাদের চারিদিকে ছায়াযুদ্ধ, শীতলযুদ্ধ, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের জটিল পরিস্থিতি। অথচ যেই সকল কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাহা করিতে মহান সৃষ্টিকর্তা নিষেধ করিয়াছেন। পবিত্র কুরআন শরিফে বলা হইয়াছে—‘পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কোরো না।’ (সুরা-২ আল-বাকারা, আয়াত : ১১)। মানুষ তো এই বিশ্বপ্রকৃতির অংশ। মানুষকে মনোযোগ দিয়া বিশ্লেষণ করিলে বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য উপলব্ধি করা যায়। আবার বিশ্বপ্রকৃতির মাধ্যমেও চেনা যায় মানুষের প্রকৃতি। আমরা নৈর্ব্যক্তিকভাবে পুরা বিষয়টি বুঝিতে চেষ্টা করিলে দেখিতে পাইব—যে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ন্যূনতম দুইটি পক্ষের অস্তিত্ব থাকে। উজান হইতে জলস্রোত ভাটির দিকে গড়াইয়া পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বন্দ্বে। গ্রীষ্মের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাইলে বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রার হেরফের ঘটে। উষ্ণ বায়ু হালকা হইয়া ধাবিত হয় তুলনামূলক শীতল বায়ুর দিকে। তাহার সহিত জলীয়বাষ্প যুক্ত হইয়া সৃষ্টি হয় ঝড়ের। ঝড় শেষে ঠান্ডা হয় প্রকৃতি। উষ্ণতাও চলিয়া যায়, ঝড়ও থামিয়া যায়।
এই জগত্ এক সমস্যাসংকুল জায়গা। এইখানে পথে-পথে পদে-পদে বিপদ-আপদ ঝামেলা-জটিলতা ছড়াইয়া-ছিটাইয়া রহিয়াছে। ঘরে ও বাহিরে—সকল ক্ষেত্রেই ইহা সত্য। এই জন্য যখন কেহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন তখন তাহাতে শপথ লইতে হয় যে, তিনি কোনো কাজ ‘রাগ-অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হইয়া’ করিবেন না। সুতরাং আমাদের দায়িত্বপূর্ণ কোনো কাজে ‘রাগ-অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হইবার কোনো অবকাশ নাই। যদিও অনেকে ইহা স্মরণে রাখেন না। যাহারা রাখেন না, ইহা তাহাদের সমস্যা। নিয়ম অনুযায়ী তাহাদের দায়িত্বপূর্ণ কোনো পদে আসীন থাকিবার যোগ্যতা থাকে না। তবে যেইখানে আগাছা অধিক, সেইখানে অনিয়মই নিয়ম হইয়া যায়। আর তাহাতেই যত অনিষ্ট ঘটে। তাহারাই সিলসিলা আমরা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দেখিতে পাই। এই অবস্থায় আরো অধিক মাথা ঠান্ডা রাখিতে হইবে। কারণ, প্রথমেই বলা হইয়াছে—সমস্যার সমাধান কখনো তপ্ত মাথায় আসে না, আসে ঠান্ডা মাথায়। সমস্যা সমাধানের জন্য হইলেও মাথা ঠান্ডা রাখিতে হইবে।