উনিশ শতকের প্রখ্যাত ইংরেজ কবি জোসেফ রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের মা-সংক্রান্ত একটি উদ্ধৃতি বিশ্বময় খ্যাতি পাইয়াছে। তিনি লিখিয়াছেন :‘গড কুড নট বি এভরিহোয়ার, অ্যান্ড দেয়ার ফর হি মেড মাদারস।’ অর্থাত্, ঈশ্বর সর্বত্র থাকিতে পারেন না, এই জন্য তিনি মায়েদের সৃষ্টি করিয়াছেন।
ঈশ্বর নিশ্চয়ই সর্বত্র বিরাজ করেন; কিন্তু রুডইয়ার্ড কিপলিং মূলত বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, ঈশ্বর যেমন তাহার সৃষ্ট প্রাণের প্রতি দরদি, তেমনি ঈশ্বরের পরে এই বিশ্বজগতে সবচাইতে দরদি সত্তা হইল ‘মা’। তাহা শুধু মানুষের মধ্যেই নহে, সকল প্রাণীর মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে, মায়ের বিশালত্ব কোনো কিছু দিয়াই পুরাপুরি তুলিয়া ধরা সম্ভব নহে। খ্যাতিমান কবি কাজী কাদের নেওয়াজ তাহার ‘মা’ কবিতায় এই জন্য লিখিয়াছেন—‘মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই,/ ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।’ পৃথিবীর সকল বিখ্যাত মানুষের আত্মজীবনীতেই মায়ের ভূমিকা ও অবদান দারুণভাবে উদ্ভাসিত। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন যেমন বলিয়াছেন, ‘আমি যাহা হইয়াছি বা ভবিষ্যতে যাহা হইতে চাহি, তাহার সকল কিছুর জন্য আমি আমার মায়ের নিকট ঋণী।’ বিশ্বখ্যাত ফুটবলার দিয়াগো ম্যারাডোনা বলিয়াছেন, ‘আমার মা মনে করেন আমিই সেরা, আর মা মনে করেন বলিয়াই আমি সেরা হইয়া গড়িয়া উঠিয়াছি।’ ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বেনোপার্টের মা-সংক্রান্ত উক্তিটি তো জগদ্বিখ্যাত—‘আমাকে শিক্ষিত মা দাও; আমি তোমাদের একটা সভ্য, শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ মাতৃসত্তা আসলে কী জিনিস, তাহার অসাধারণ উদাহরণ পাওয়া যায় কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের একটি কবিতার মধ্যে। কবিতাটির সারবত্তা এইরকম—রাজপুত্রের মা হইবে বলিয়া এক ডাইনি রাজপুত্রের আসল মাকে পাথর বানাইয়া ফেলিল। তাহার পর রাজপুত্রকে পরম মমতায় কোলেপিঠে করিয়া বড় করিল। বড় হইয়া সেই রাজপুত্র জানিতে পারিল তাহার মা আসলে ডাইনি। রাজপুত্র তখন এক পূর্ণিমার রাতে দিঘির ভিতরে ডুব দিয়া কৌটায় থাকা ভোমরার গলা টিপে হত্যা করিল ডাইনিটাকে। ডাইনিটা তখনো দিঘির পাড়েই দাঁড়াইয়া ছিল। রাজপুত্র একবারও ভাবিল না, সে যখন কৌটা খুলিতেছিল, ডাইনিটা ইচ্ছা করিলে তখনো তাহাকে পাথর বানাইয়া ফেলিতে পারিত!
স্পষ্টতই, প্রকৃতি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, ডাইনিও যদি মা হয়, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা সেই ডাইনির নিকট নিজের জীবনের চাইতেও বড় হইয়া উঠে। পৃথিবীতে অনেক দিবস রহিয়াছে, মায়েদের জন্য তো একটি নির্দিষ্ট দিন থাকিতেই হইবে। প্রতি বত্সর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারই আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবস উদ্যাপন করা হয়। ইহার নেপথ্যে রহিয়াছে আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন শহরের একটি কাহিনি। ঐ শহরের অ্যানা জার্ভিস নামের এক নারী তাহার মা অ্যান মারিয়া রিভস জার্ভিসের মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকাচ্ছন্ন হইয়াছিলেন। তিনি ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব করিয়া সমাজের পিছাইয়া পড়া নারীদের জন্য কাজ করিতেন। মায়েদের জন্য তাহার ভাবনটি ছিল এই রকম—‘আমি প্রার্থনা করি, একদিন কেহ না কেহ কোনো মায়ের জন্য একটা দিন উত্সর্গ করুক। কারণ মায়েরা প্রতিদিন মনুষ্যত্বের জন্য নিজেদের জীবন উত্সর্গ করিয়া চলিয়াছেন। ইহা তাহাদের অধিকার।’ মায়ের প্রতিটি শব্দ মনে রাখিয়াছিলেন অ্যানা। আর সেই কারণেই অ্যানের মৃত্যুর দিনটিকে (১২ মে ১৯০৭) সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি মায়ের উদ্দেশে উত্সর্গ করেন তিনি। তাহার পর হইতেই মায়েদের প্রতি সম্মানে পালিত হইয়া আসিতেছে মা দিবস।
এই ‘ধরণি’কেও আমরা তুলনা করি মায়ের সহিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াছেন, ‘জননী অমৃতময়ী!’ গীতাঞ্জলির একটি কবিতায় তিনি লিখিয়াছেন, ‘জননী, তোমার করুণ চরণখানি/ হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে।/ জননী, তোমার মরণহরণ বাণী/ নীরব গগনে ভরি উঠে চুপে চুপে।’ বাংলায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হইল দাঁত থাকিতে দাঁতের মর্যাদা না বুঝা। ইহার ব্যাখ্যায় বলা হয়, মা জীবিত থাকিতে অনেক সময় আমরা মায়ের গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুধাবন করিতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে, এই জগতে তাহারাই ধনী, যাহাদের মা বাঁচিয়া রহিয়াছেন। এই কারণে মা যত দিন আছেন, তত দিনই আমরা সৌভাগ্যবান থাকিব মায়ের সেবা করিতে। মাতা-পিতার অবর্তমানে কবরের নিকট গিয়া আমরা প্রার্থনা করিতে পারি—‘রব্বির হামহুমা কামা রব্বাইয়ানি সগিরা।’ অর্থাত্, ‘হে আমার প্রতিপালক, আপনি তাহাদের (মাতা ও পিতার) প্রতি রহম (দয়া) করুন, যেই রকম তাহারা আমাকে শিশুকালে (মায়া-মমতা ও স্নেহপরায়ণ আচরণ দ্বারা) লালনপালন করিয়াছেন।’