গতকাল সমগ্র দেশে একযোগে প্রকাশিত হইয়াছে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাহার সরকারি বাসভবন গণভবনে এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল বোতাম টিপিয়া এই ফলাফল প্রকাশ করেন। এই সময় প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রাখিয়া বলেন, ‘ছেলেরা সংখ্যায় কম কেন, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।’ তাহার ভাষায়, ‘ছেলেদের সংখ্যা কমার কথা নয়, (মেয়েদের) সমান হওয়া উচিত।’ তাহারা সংখ্যায় কেন কম ও কেন ফলাফলে পিছাইয়া রহিয়াছে তাহারই অনুসন্ধান চালাইবার জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও শিক্ষা বোর্ডগুলোকে নির্দেশ দিয়াছেন তিনি।
প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, এইবার ৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ ছাত্রী পাশ করিয়াছে। আর ছাত্র পাশ করিয়াছে ৮১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। মোট ৯৮ হাজার ৭৭৬ জন ছাত্রী জিপিএ-৫ পাইয়াছে। আর ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন ছাত্র পাইয়াছে জিপিএ-৫। অর্থাত্ পাশ ও জিপিএ-৫ অর্জন—উভয় হারেই পিছাইয়া আছে ছেলেরা। শুধু তাহাই নহে, গত সাত বত্সরের মাধ্যমিক পর্যায়ের ফলাফল বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, পাশের হারের দিক হইতে ছেলেদের তুলনায় ছাত্রীরা আগাইয়া রহিয়াছে। ইহার কারণ কী? আসলে এই পরীক্ষায় ছেলেদের অংশগ্রহণই মেয়েদের তুলনায় কম। যেমন, ২০ লক্ষ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্র ছিল ৯ লক্ষ ৮৮ হাজার ৭৯৪ জন। আর ছাত্রী ছিল ১০ লক্ষ ২৪ হাজার ৮০৩ জন। শুধু কি তাহাই শেষ কথা? আমরা যদি দেশের জনসংখ্যার দিকে চক্ষু বুলাই, তাহা হইলে দেখিতে পাই, ১৭ কোটি ১৫ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৪২ লক্ষ এবং নারী ৮ কোটি ৭৩ লক্ষ। যেহেতু দেশে পুরুষের চাইতে নারীর সংখ্যা অধিক, তাই মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ও উত্তীর্ণের সংখ্যায় মেয়েরা অধিক থাকিবে, ইহাই স্বাভাবিক।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নেরও যৌক্তিকতা রহিয়াছে। একসময় নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা এমনিতেই কম ছিল। আবার যাহা ছিল তাহারা বাল্যবিবাহসহ নানা কারণে ঝরিয়া পড়িত। সেই সময় মেয়েদের পিছাইয়া পড়িবার বিষয়টি ছিল আলোচিত; কিন্তু মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা ও উপবৃত্তি প্রদানসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এমনকি স্কুল-কলেজেও এখন নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়িয়াছে। ফলাফলের দিক হইতেও তাহারা অনেক ক্ষেত্রে ছেলেদের চাইতে ভালো করিতেছে। এমনকি সরকারি-বেসরকারি চাকুরির ক্ষেত্রেও তাহারা এখন আগাইয়া আসিতেছে। সেই তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাইতেছে, ছেলেরা পিছাইয়া পড়িতেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একসময় যাইত ৫৪ শতাংশ ছাত্রী। এখন সেইখানে ৯৮ শতাংশ মেয়ে স্কুলে যায়। এখন প্রশ্ন হইল, কমসংখ্যক ছেলে স্কুলে যাইতেছে কেন? ইহা কি দেশ ও দশের জন্য উদ্বেগজনক নহে?
ইহাতে প্রমাণিত হয়, নারীশিক্ষার প্রতি আমাদের গুরুত্বারোপ করা সার্থক হইয়াছে। নারীশিক্ষার অগ্রগতি নিঃসন্দেহে সুখের বিষয়। তবে ছেলেরাও পিছাইয়া থাকিতে পারে না; কিন্তু অভাবী পরিবারের ছেলেরা এখন অল্প বয়সেই বিভিন্ন কাজে লাগিয়া যাইতেছে। শিশু শ্রমিকদের অধিকাংশই ছেলে। করোনা মহামারির সময় বিভিন্ন পরিবার অভাব-অনটনে পড়ে। সেই সময় অনেক পরিবারের ছেলেরা বাধ্য হইয়া বিভিন্ন কলকারখানা বা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসাবে নিয়োজিত হয়। ছেলেদের পিছাইয়া পড়িবার ইহা অন্যতম কারণ হইতে পারে। মাদকাসক্তি ও কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়াইয়া পড়িবার কারণেও বিদ্যালয়ে যাওয়া ছেলেদের সংখ্যা কমিতে পারে। এই জন্য এখন ছেলেদের লইয়া ভাবিবার সময় আসিয়াছে। তাহাদের জন্য বিশেষ উপবৃত্তি চালু করা যায় কি না, তাহা চিন্তাভাবনা করিয়া দেখা দরকার। তাহা ছাড়া মাধ্যমিক পর্যন্ত সকলের জন্যই শিক্ষা অবৈতনিক হওয়া প্রয়োজন। এই একবিংশ শতাব্দীতে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে এখন ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনো প্রকার বৈষম্য করিবার অবকাশ নাই।
বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার বাড়িয়া হইয়াছে ৭৬ শতাংশ। শতভাগ সাক্ষরতার হার নিশ্চিত করিতে হইলে ছেলে শিশুদের প্রতিও যত্ন নিতে হইবে। কোনো ছেলে স্কুলে না গেলে তাহাদের অবশ্যই শিক্ষার আওতায় আনিতে হইবে।