রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

ইতিহাস তাহাদের ক্ষমা করিবে না

আপডেট : ১৪ মে ২০২৪, ০৪:৩০

বিশ্বব্যবস্থা যখন দুর্বল হইয়া পড়ে এবং পরাশক্তিদের মধ্যে তৈরি হয় বড় ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, তখন দেশে দেশে দেখা যায় যুদ্ধবিগ্রহ ও অস্থিরতা। এমন অবস্থায় গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা বা সংকট থাকিবে না—তাহা হইতে পারে না। তবে ইহার মধ্যেও বতসোয়ানা, মরিশাস, সেনেগাল, নাইজেরিয়া, তিউনিসিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আফ্রিকার অন্তত ১১টি দেশে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা আশাব্যঞ্জক। কারণ এই সকল দেশে নির্বাচনি ব্যবস্থা ক্রমশ শক্তিশালী হইয়া উঠিতেছে। মানুষ তাহার গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার হইতেছে। এই সকল দেশের অধিকাংশের স্বাধীনতা লাভ বা গণতন্ত্রের বয়স যে খুব বেশি, তাহা নহে। বিশ্বের হতাশাজনক পরিস্থিতিতেও আফ্রিকার এই দেশগুলিতে গণতন্ত্রের সাফল্য দেখিয়া আমরা যারপরনাই খুশি; কিন্তু এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল অনেক দেশে গণতন্ত্রের অবনমন হইতেছে দুঃখজনকভাবে। এমনকি পৃথিবীর সর্ববৃহত্ গণতান্ত্রিক দেশের অবস্থাও খুব বেশি আশাপ্রদ নহে। এই সকল দেশে মানবাধিকার, আইনের শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পড়িতেছে হুমকির মুখে।

তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় বা স্থানীয় পর্যায়ে যেই সকল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতেছে, সেইখানে ঘটিতেছে নানা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া হুমকি-ধমকি, বোমাবাজি, মারামারি, হানাহানি, হাতাহাতি, খুনাখুনি, বুথ বা কেন্দ্র দখল, এজেন্টকে বাহির করিয়া দেওয়া ইত্যাদি যেইভাবে বাড়িয়া চলিয়াছে তাহাতে আমরা উদ্বিগ্ন। ভোট দিতে বাধা বা প্রতিপক্ষের উপর পরিকল্পিত হামলার মাধ্যমে নির্বাচনি পরিবেশকে প্রভাবিত ও বিষাক্ত করিবার এই হীন চেষ্টা নিন্দনীয়। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ ও ক্ষমতার হস্তান্তর ব্যতীত গণতন্ত্র ফলপ্রসূ হইতে পারে না; কিন্তু যখন প্রার্থী ও তাহার সমর্থকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও সাজানো মামলা দিয়া আটকানোর চেষ্টা করা হয়, তাহাদের ঘরবাড়ি ও এলাকায় থাকিতে দেওয়া হয় না, নির্বাচনের পূর্বে ও পরে তাহাদের উপর ন্যক্কারজনকভাবে হামলা করা হয়, নির্বাচনি অফিস এবং ঘরবাড়ি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যকেন্দ্র ভাঙচুর করা হয় বা অগ্নিসংযোগ করা হয়, অবৈধ অর্থের ছড়াছড়ি চলে, তখন সাধারণ ভোটারদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। সবচাইতে দুঃখজনক হইল, এই সকল অপকর্মের পরও অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনকি স্পর্শকাতর বিভাগের পক্ষ হইতে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা তো হয়ই না, বরং অনেক সময় অপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করা হয়। এই পরিস্থিতি মোটেও কাম্য নহে।

যেই সকল দেশে এই সকল অন্যায় ও অপকর্ম করিয়া ক্ষমতাসীনরা পার পাইয়া যাইবেন বলিয়া মনে করেন, তাহারা আসলে বোকার স্বর্গে বসবাস করিতেছেন। তাহারা সাময়িকভাবে লাভবান হইলেও ইতিহাস তাহাদের কখনো ক্ষমা করিবে না। এইভাবে একটি প্রজন্ম বা জাতিকে ধোঁকা দেওয়া যাইতে পারে; কিন্তু একদিন ঠিকই সঠিক ইতিহাস বাহির হইয়া আসিবে। তখন বিচার-বিশ্লেষণ করিয়া দেখা যাইবে, তাহারা দেশ ও জাতির কী সর্বনাশ ও ক্ষতি করিয়াছেন! ছোট ও বড় নির্বাচনি ব্যবস্থাকে তাহারা ধ্বংস করিয়া দিয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, তাহারা যে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির কথা বলিতেন, তখন দেখা যাইবে তাহা মিথ্যার বেসাতি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প কাটছাঁট, ঠিকমতো বিল বা অর্থ দিতে না পারা, দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধ করিতে না পারা ইত্যাদির গল্প পড়িয়া পরবর্তী প্রজন্ম বিস্মিত হইবেন। তাহারা দেখিতে পাইবেন রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ সকল কিছুতে সেই সময় ছিল একধরনের স্থবিরতা।

অতএব, ইতিহাস হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিয়া আমাদের গণতন্ত্র রক্ষা ও ইহার বিকাশে নিরন্তর কাজ করিয়া যাইতে হইবে। কথায় বলে :অতিচালাকের গলায় দড়ি। গণতন্ত্রকে নস্যাত্ করিয়া অতিচালাকের পরিণামও একই হইতে বাধ্য, ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই। এই জন্য অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাহার ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম’ গ্রন্থে উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়াছেন মর্মে মর্মে। সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করিতে হইলে গণতন্ত্র ছাড়া তাহা সম্ভব নহে।

ইত্তেফাক/এমএএম