রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

গণতন্ত্র যেইখানে দুধের বদলে ঘোল

আপডেট : ১৫ মে ২০২৪, ০৩:১২

উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশেই সাংবিধানিকভাবে ‘গণতন্ত্র’ রহিয়াছে; কিন্তু গণতন্ত্র যে আসলে কী জিনিস—তাহার বিপরীতে এই সকল দেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক হানাহানি, হিংস্রতা, রক্তের হোলি খেলা দেখিয়া চমকাইয়া যাইতে হয়। নির্বাচনে সহিংসতা কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী—তাহা আমরা কয়েক দশক ধরিয়া একটি বৃহত্ উন্নয়নশীল দেশের সকল ধরনের নির্বাচনে দেখিয়া আসিতেছি। সেইখানে নির্বাচনে ধাওয়া-পালটাধাওয়া, হামলা-প্রতিহামলা, ভাঙচুর-নৃশংসতা, হানাহানি, খুনাখুনির মতো হেন খারাপ দৃষ্টান্ত নাই যাহা হয় না। ধারালো অস্ত্রের আস্ফাালন আর বোমাবাজি তো আছেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হইতে পারে—‘ওরে বাবা! এই কেমন নির্বাচন!’

এই সকল বিষয় দেখিয়া শুনিয়া বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের মতো আমাদের উপলব্ধি হয়—জ্ঞানসমুদ্রের তীরে আমরাও যেন নুড়ি কুড়াইতেছি মাত্র। আরো কত দেখিবার আছে! বুঝিবার আছে! তৃতীয় বিশ্বের এমনতর গণতন্ত্র দেখিয়া আমাদের মনে পড়িয়া যায় মহাভারতে বর্ণিত দ্রোণাচার্যের পুত্রের কথা। অস্ত্রশিক্ষাগুরু দ্রোণাচার্যের প্রিয়পুত্র অশ্বত্থামা ছোটবেলায় ধনীপুত্রদের দেখাদেখি দুধ খাইতে চাহিতেন; কিন্তু দরিদ্র দ্রোণাচার্যের পক্ষে সম্ভব ছিল না দুগ্ধ ক্রয় করিবার; কিন্তু পুত্রের আশা মিটাইতে তিনি দুগ্ধের পরিবর্তে চালবাটা পিটুলি গোলা দিয়া পুত্রকে বলিতেন—ইহাই দুধ। তাহার গরিব পুত্রও চালবাটা পিটুলি গোলা খাইয়াই ‘দুধ খাইতেছি’ ভাবিয়া আনন্দ করিতেন এবং নিজেকে ধনীপুত্রদের সমতুল্য মনে করিতেন। অনেকেই মনে করেন, তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেরই গণতন্ত্রই হইতেছে অশ্বত্থামার চালবাটা পিটুলি গোলা খাইবার মতো। উহা আসলে দুধ বা গণতন্ত্র নহে। প্রথম কথা হইল—গণতন্ত্র হইল স্টেট অব মাইন্ড। সেইখানে কথা বলিবার যেমন অবারিত স্বাধীনতা থাকিবে, মুক্তচিন্তার ফল্গুধারা বহিবে, ইহার পাশাপাশি বিপরীত বা ভিন্ন মতের অন্যকে সম্মান করিবার বিষয়টিও থাকিতেই হইবে; কিন্তু গণতন্ত্রের এই মূলগত বৈশিষ্ট্য—তাহা আমরা উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশেই দেখিতে পাই না। ইহা যেন গণতন্ত্র নামক দুধের বদলে চালবাটা গোলানো পিটুলি গোলা গিলানো। উন্নয়নশীল বিশ্বের জনগণও সেই ‘পিটুলি গোলা’ পান করিয়া ‘দুধ খাইয়াছি’ ভাবিয়া তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে।

বিশ্বব্যাপী দেশগুলির গণতন্ত্রের সূচক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পাঁচটি বিষয় বিবেচনা করা হইয়া থাকে। সেইগুলি হইতেছে—নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং নাগরিক স্বাধীনতা। পৃথিবীতে যেই সকল দেশে গণতন্ত্রের অবনমন ঘটিতেছে সেই দেশগুলিতে এই পাঁচটি বিষয়ের উপর ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য বিস্তার করিতে দেখা যায়। এমনকি অনেক পুরাতন শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশও দেখা যাইতেছে বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার জলাঞ্জলি। স্পষ্টতই, তৃতীয় বিশ্বে গণতান্ত্রিক মন্দাদশা দিনদিন বাড়িতেছে, ইহার বিপরীতে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার প্রসার ঘটিতেছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করিবার উদ্দেশ্য তৃতীয় বিশ্বে গাল ফুলাইয়া বলা হয়—কেহ আইনের ঊর্ধ্বে নহে। অথচ যেই অপরাধের জন্য তাহাকে আইনের শাসানি দেওয়া হইল, দেখা যাইবে সেই অপরাধ শতসহস্র মানুষ করিয়াছে কিংবা করিতেছে; কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে আইন যেন চক্ষু মুদিয়া রহিয়াছে। অথচ সত্যিকারের আইনের প্রয়োগ হইলে সকলের ক্ষেত্রেই তাহা সমানভাবে হওয়া উচিত। এই ব্যাপারে স্বনামধন্য ফরাসি পণ্ডিত মন্টেস্কু তাহার ‘দ্য স্পিরিট অব দ্য লজ’ গ্রন্থে স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন—‘অভিজ্ঞতা আমাদের অনবরত দেখাইতেছে যে প্রত্যেক ব্যক্তি, যাহার হাতে ক্ষমতা রহিয়াছে, তিনি তাহা সুকৌশলে অপব্যবহার করিয়া চলেন এবং তাহাকে রুখিয়া না দেওয়া পর্যন্ত তিনি তাহার কর্তৃত্বপরায়ণতা বজায় রাখিয়া চলেন।’ 

প্রকৃতপক্ষে, আইনের শাসনের অভাব থাকিলে কী হইতে পারে—তাহার জলজ্যান্ত উদাহরণ বর্তমানে আইনের স্বর্গোদ্যানখ্যাত জার্মানিতেই একসময় দেখা গিয়াছিল। নািস আমলে বিচারের নামে যেই প্রহসন চলিত আদালতকক্ষে, তাহা আজও সিনেমা বা পুরাতন তথ্যচিত্রে যে কেহ দেখিলে তাহার শরীর দিয়া শীতল রক্তস্রোত বহিয়া যাইবে। বিচারকরা নিরপরাধ আসামিদের উপর হম্বিতম্বি করিয়া তাহাদের কথা বলিতে দিতেন না। রায় ছিল পূর্বনির্ধারিত। দূরভবিষ্যতে তৃতীয় বিশ্ব যদি আর তৃতীয় না থাকে—তখন বর্তমান সময়ের ‘গণতন্ত্র’ ও ‘আইনের শাসন’ দেখিয়া ভবিষ্যত্ মানুষের শরীর দিয়া কি শীতল রক্তস্রোত বহিয়া যাইবে না?

ইত্তেফাক/এমএএম