কেহ কেহ বলিয়া থাকেন—জীবন মানেই যন্ত্রণা, বাঁচিয়া থাকিতে উহা শেষ হইবে না। তবে মরণের পরও স্বস্তি আছে কি না—তাহাও ভাবিয়া দেখিতে হইবে। মাটির সহিত মিশিয়া যাইবার প্রক্রিয়ায় লক্ষ-কোটি জীবাণু আর পোকামাকড় ভক্ষণ করিবে আমাদের এই সুন্দর দেহখানি। দেহ না হয় মাটির সহিত মিশিয়া যাইবে; কিন্তু রুহ বা আত্মার কী হইবে? প্রশ্ন অনেক। তবে যেই জীবনখানি উন্নয়নশীল বিশ্বের মানুষ যাপন করিতেছে—সেই জীবনে ভোগান্তির শেষ নাই। তাহার কারণ হইল, উন্নয়নশীল দেশের কোনো কোনো অংশ যেন নরকের ক্ষুদ্র সংস্করণ। এইখানে পদে পদে ভোগান্তি। আর সেই ভোগান্তি দূর করাটাই হইল প্রকৃত নেতার ক্যারিশমা; কিন্তু যদি দুর্বলের শাসন হয়, তখন তাহা ভয়ংকর হয়—যেমনটি বলা হইয়াছে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় মুখ্য চরিত্র অমিত বলিয়াছেন—‘দুর্বলের আধিপত্য অতি ভয়ংকর।’
মানুষ যখন সভ্য হইয়া উঠে নাই, তখনো আধিপত্য বিস্তারের জন্য কাদা ছোড়াছুড়ি করিয়াছে। প্রস্তরযুগ হইতে শুরু করিয়া আধুনিক এই তথাকথিত সভ্য সময় পর্যন্ত মানুষ লক্ষাধিক বড় বড় যুদ্ধ করিয়াছে। এই জন্য অনেক ইতিহাসবেত্তা বলিয়া থাকেন, মানবজাতির ইতিহাস মূলত যুদ্ধের ইতিহাস। সুতরাং প্রশ্ন যদি করা হয় যুদ্ধ কেন হয়—তাহার চাইতে বড় কথা হইল—যুদ্ধ বাদ দিলে মানবজাতির ইতিহাসের পাতা সাদা থাকিয়া যাইবে। মানুষ শুরুতে থাকিত গুহায়। প্রাচীনকালে মানুষ বুদ্ধি খাটাইয়া সংঘবদ্ধভাবে বসবাসের অভ্যাস করিল। সত্যিকার অর্থে, একটি জাতি বা একটি গোষ্ঠী যাহাতে সম্মানের সহিত ভালোভাবে জীবনধারণ করিতে পারে, সেই ইচ্ছা ও চেষ্টা যে কোনো ধীশক্তিসম্পন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্রভাবে থাকে; কিন্তু ইচ্ছা বা চেষ্টা থাকিলেই তো হইবে না, ইহার জন্য দরকার নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উন্নত নেতার। প্রকৃতিগতভাবে যে কোনো গোষ্ঠী তৈরি হইলেই তাহাদের জন্য একজন ‘নেতা’র প্রয়োজন হয়। এই নেতা হয় পৌরুষসম্পন্ন, কারণ বাহ্যিকভাবে দৈহিক শক্তিই পশুবত্ তত্কালীন মানুষের সেরা স্বীকৃত গুণ ছিল। তাহা ছিল অবশ্যই রজোগুণ। যেই গোষ্ঠী শান্ত, স্বাভাবিক জীবনযাপন করিত, তাহার নেতা অবশ্যই সত্তাগুণসম্পন্ন ব্যক্তি। রজোগুণসম্পন্ন নেতার অনেক বৈশিষ্ট্যই অশান্তি ডাকিয়া আনিত—তাহা সহজেই অনুমান করা যায়। এই অশান্তি বা যুদ্ধের প্রধান দুইটি উপাদান হইল—খাদ্য, সম্পদ ও নারী। তবে ইহা তো আদি মানুষের যুদ্ধ; কিন্তু মানুষ যখন ক্রমশ সভ্য হইতে থাকে তখন যুদ্ধের ভূগোল ও উপকরণ পরিবর্তিত হইতে থাকে। সভ্যতা নামক এক ফানুসে চাপিয়া যুদ্ধে সম্পৃৃক্ত হইতে হইতে সমাজ অগ্রসর হইতেছিল। বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের যত উন্নয়ন ঘটিয়াছে যুদ্ধেরও তত বিকাশ ঘটিয়াছে। ‘ওর্য়াল্ড বিয়ন্ড ওয়ার’ সংস্থা হইতে জানা যায়, ৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব হইতে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সহস্রাধিক প্রধান প্রধান যুদ্ধ সংঘটিত হইবার ইতিহাস নথিভুক্ত হইয়াছে। বিংশ শতাব্দীতে আনুমানিক ১৬৫টি যুদ্ধে প্রায় ২৫ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়াছে।
ইতিহাস সাক্ষী দেয়, দুর্বল পরিবেশ হইতে উঠিয়া আসা নেতা সাধারণত নিজের ক্ষমতা দেখাইতে অধিক অস্থির থাকেন। এই জন্য দুর্বলের প্রতিহিংসাও হয় ভয়ংকর। সেই কারণেই একজন লিডার বা নেতার বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে জ্ঞানীগুণীরা বলিয়া থাকেন—নেতা হইবে সবল ও ভিন্ন ধ্যানজ্ঞানচেতনার। তিনি যদি সাধারণ মানুষের মতোই হন, তাহা হইলে তাহার নেতৃত্বে একটি জাতি কী করিয়া সর্বোত্তমভাবে বিকশিত হইবে? একজন যোগ্য নেতার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকিতেই হয়, যাহা অন্যদের মধ্যে নাই। তাহার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, সহযোগিতমূলক মনোভাব, ঝুঁকি ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকা চাই। ইহার পাশাপাশি যোগাযোগে দক্ষতা, দূরদর্শিতা, প্রখর স্মৃতিশক্তি ও সর্বোপরি ধৈর্যধারণের বৈশিষ্ট্য থাকাটাও অত্যন্ত জরুরি। ইহার ব্যত্যয়ে যদি কোথাও দুর্বলের শাসন চলে, তাহা হইলে সেই জাতিকে রক্ষার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেহ থাকে না।