বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৬ ফাল্গুন ১৪৩১
The Daily Ittefaq

শূন্য পাশ এবং মানসম্মত শিক্ষা

আপডেট : ১৬ মে ২০২৪, ০২:৪২

সম্প্রতি চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণ ৯টি  শিক্ষা বোর্ডসহ মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডে গড় পাশের হার ৮৩.০৪ শতাংশ। পরীক্ষায় মোট ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের মধ্যে ৯৮ হাজার ৭৭৬ জন মেয়ে এবং ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন ছেলে। উল্লেখ্য, এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। তন্মধ্যে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিল ১৬ লাখ ৬ হাজার ৮৭৯ জন, মাদ্রাসা বোর্ডে ২ লাখ ৪২ হাজার ৩১৪ জন এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৭৩ জন। ২০২৩ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিল, পাশের হার ছিল ৮০.৩৯ শতাংশ। ২০২২ সালে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন, পাশের হার ছিল ৮৭.৪৪ শতাংশ। এ বছর (২০২৪) সারা দেশের ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষার্থীই পাশ করতে পারেনি। শূন্য পাশ অবস্থানে থাকা ৫১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সর্বোচ্চ ৪২টি। এছাড়া দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে চারটি, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে তিনটি ও রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত বছর (২০২৩) শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৪৮টি। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫০টি, ২০২১ সালে ১৮টি এবং ২০২০ সালে ১০৪টি।

অতি সম্প্রতি পত্রিকায় (কালের কণ্ঠ, ০৮ মে, ২০২৪) প্রকাশিত এক তথ্যে বেরিয়ে আসে যে নেত্রকোনার একটি স্কুলের ৫৬০ জন ছাত্রের মধ্যে এক জনও স্কুলে আসেনি, এমনকি শিক্ষক-কর্মচারীরাও সময়মতো আসে না। কেউ কেউ এলেও অফিসরুমে বসে মনের সুখে ধূমপান করেন। স্কুলটিতে বর্তমানে ১৪ জন শিক্ষক ও দুজন কর্মচারী কর্মরত আছেন। দেশে এ ধরনের আরো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকতে পারে, যা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আবার এর বিপরীতটিও পরিলক্ষিত হয়। দৃষ্টিনন্দন ভবন ও মেধাবী ছাত্রে ভরপুর, কিন্তু প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। ২০২০ সালে পত্রিকায় রিপোর্ট হয় যে রাঙামাটি সদরের মগবান ইউনিয়নের তঞ্চঙ্গাপাড়া এসইএসডিপি মডেল হাই স্কুলটিতে অনেক শিক্ষার্থী থাকলেও শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য নেই কোনো শিক্ষক। দেশে এ ধরনের আরো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকতে পারে, যা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুসন্ধান করে  প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আবার এর বিপরীতটিও পরিলক্ষিত হয়। দৃষ্টিনন্দন ভবন ও মেধাবী ছাত্রে ভরপুর কিন্তু প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। ২০২০ সালে পত্রিকায় রিপোর্ট হয় যে রাঙামাটি সদরের মগবান ইউনিয়নে দোতলাবিশিষ্ট তঞ্চঙ্গাপাড়া এসইএসডিপি মডেল হাই স্কুলটিতে পড়ার জন্য অনেক শিক্ষার্থী থাকলেও শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য নেই কোনো শিক্ষক। এছাড়া শিক্ষার্থী আছে ভবন নাই, ভুয়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে উপবৃত্তির টাকা আত্মসাত্, মাসের পর মাস স্কুলে না এসে বেতন তোলাসহ নানা অনিয়মের খবর পত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশিত হয়।

তবে নিজের সঞ্চিত অর্থ, জায়গা-জমিসহ সর্বস্ব শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যয় করেন এমন শিক্ষকও সমাজে আছেন। আগের দিনে শিক্ষক ছাত্রের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতেন তার ছাত্র লেখাপড়া ঠিকমতো করে কি না। বর্তমানে এমন শিক্ষক খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ। বরং কোনো কোনো শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্য শিক্ষার্থী তথা ছাত্রীর খোঁজ নিতে এসে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার খবর মাঝেমধ্যে শোনা যায়। ইদানীং ১৬-১৮ বছরের ছাত্রীরাও  সম্পদ ও টাকার লোভে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধাকে বিয়ে করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। আর আগে বোর্ড স্ট্যান্ড করা শিক্ষার্থীকে এলাকার সবাই দেখতে এলে ভাইরাল হতো। এখন লাখ লাখ জিপিএ-৫, গোল্ডেন-৫ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। আগে স্টার-মার্কস, অর্থাত্ ৭৫০ নম্বর পেলে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজে বিনা প্রতিযোগিতায় ভর্তি হতে পারত। অন্যান্য সেরা কলেজেও বিনা মূল্যে বই, মাসিক বৃত্তিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ভালো শিক্ষার্থী ধরে রাখার চেষ্টা করা হতো। এখন দেশে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, বিশ্বমানের শিক্ষা কারিকুলাম প্রণীত হয়েছে, কম্পিউটার-ইন্টারনেট-মাল্টিমিডিয়ার সমন্বয়ে স্মার্ট ক্লাসরুম তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, চলছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী ও কর্মমুখী শিক্ষার চর্চা। এত কিছুর পরও কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষা কি অর্জিত হচ্ছে—এ প্রশ্ন এখন অনেকেরই।

প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় এবং বিশ্বমানের সব শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষাতথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত। সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বিশ্ববাসী চতুর্থ বিপ্লব জয় করে পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের দিকে এগোচ্ছে। বাংলাদেশও ২০৪১ সালের মধ্যে শিক্ষা, চিকিত্সা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্ব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তায় স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের রোডম্যাপ দিয়েছে, কিন্তু এই কাজে সফল হতে হলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিন্ত করা খুবই জরুরি। আরো জরুরি প্রযুক্তির সুবিধা ও অসুবিধা অনুধাবন করা। অভিভাবক এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর ধারণা, প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণেই অনেক শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকার জগতে ডুবে যাচ্ছে। লেখাপড়ার ছলে তারা টিকটক, পাবজি ও নানা বিনোদনে মূল্যবান সময় কাটাচ্ছে এবং অভিভাবকের কষ্টার্জিত টাকা অপচয় করছে এমবি কিনে। এসব কাজে সারা রাত জেগে থাকায় দিনের বেলায় ক্লাসে ও পড়ার টেবিলে বসে ঝিমায়। অনিদ্রায় তাদের চেহারা ও স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। মন, মেজাজ ও ব্যবহারে স্বাভাবিকতা থাকে না। ফলে লেখাপড়ায় তাদের মন বসে না, পরীক্ষায় ফেল করে।

ভালো ফলাফলের জন্য প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকটি পরিহার করে ইতিবাচক বিষয়গুলোর দিকে শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করতে শিক্ষক ও অভিভাবক উভয়কেই সচেতন হতে হবে। পরিবারই হচ্ছে সন্তানের আদর্শ শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু আজকাল অনেক মা-বাবা দুজনই চাকরি করায় তাদের সন্তানেরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা থেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো ফলাফলের জন্য পারিবারিক এই শিক্ষাগুলো খুবই জরুরি। অবশ্যই ঘরের কোণে বসে ডিজিটাল ডিভাইসে খেলার পরিবর্তে উন্মুক্ত মাঠে খেলার পুরোনো সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিচালনা কমিটির সদস্য এবং শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে এবং মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

ইত্তেফাক/এমএএম