বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গোড়াপত্তন থেকেই গান অনেক বড় একটি স্থান দখল করে আছে। আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা গানও ব্যাপকভাবে আধুনিকতার স্পর্শ পেয়েছে। তদুপরি পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের কুপ্রভাবে বাংলা গান বারবার কলুষিতও হয়েছে। কিন্তু এই উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষী সংস্কৃতিপ্রেমীরা সেসব অপসংস্কৃতির চর্চাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি এসব অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই জনপদের গীতিকবিরা গান রচনা করেই তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। যা শ্রোতাসাধারণের মাঝেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিশিষ্ট গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার লিখেছেন, ‘আউল বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন আইলো রে, আরে সবার মাথা খাইলো রে।’ সত্যিই তখন এই কথাগুলো সকলের মনের কথা ছিল। এখন আবারও বাংলা গান এবং গানের প্রচলিত সুর বিকৃতির প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। পাশ্চাত্যের অত্যাধুনিক বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জনপ্রিয় গানগুলোকে রিম্যাক করা হচ্ছে। কখনো কখনো সেসব জনপ্রিয় গানের মূল শিল্পীকে সঙ্গে রাখা হয়, আবার কখনো ভিন দেশের শিল্পী এনে গানগুলোর মূল কথা ও সুরকে জলাঞ্জলি দিয়ে পুনরায় মিউজিক ভিডিও ধারণ করা হয়। এরপর এগুলো বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় আপলোড দিয়ে করা হয় মোটা অঙ্কের ভিউ বাণিজ্য। এই প্রক্রিয়ায় কখনো গানগুলোর গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীকে অবহিত করা হয়, আবার কখনো তাদের এড়িয়ে যাওয়া হয় কৌশল খাটিয়ে। যখন গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীকে অবহিত করা হয়, তখন তাদের খুশি রাখতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ভালো অঙ্কের একটি চেক। আর যখন তাদের অগোচরে নতুনভাবে গানগুলো রেকর্ড করা হয় তখন বিভিন্ন টেকনিক অবলম্বন করে। এর মধ্যে একটি অন্যতম টেকনিক হলো গানের মূল গীতিকবির নাম ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গিয়ে অন্য আরেকজন গীতিকবির নাম ব্যবহার করা! এতে ঐসব সংগীত বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক ধাপে লাভবান হয়—
প্রথমত, গানের মূল গীতিকবিকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যায়; যাতে তিনি কোনোরকম আর্থিক আবদার না করতে পারেন। অর্থাত্ গান রিম্যাক করার আগে গানের মূল গীতিকবি বা তার স্বত্বাধিকারী কাউকে কোনো টাকা-পয়সা দিতে হয় না।
দ্বিতীয়ত, গানটি যে গীতিকবির বলে দাবি করা হয় তার পক্ষ থেকে শক্ত একটি সমর্থন তৈরি করা। অর্থাত্ গানের মূল গীতিকবিকে এড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে আরেকজন গীতিকবির নামে গানটি প্রচার করে গান প্রচারের পক্ষে বিশাল জনসমর্থন গড়ে তোলা, যাতে কিছু মানুষ ক্ষুব্ধ হলেও গানটি পরিকল্পনা অনুযায়ী সফলভাবে বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় টিকে থাকে।
তৃতীয়ত, গীতিকবির নাম নিয়ে বিতর্ক তৈরি করার ফলে গানটি প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক হইচই সৃষ্টি করে এবং দেশের মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোও ইস্যুটি বড় ভেবে সংবাদ প্রচার করে; যার পরিপ্রেক্ষিতে যারা নতুন রিম্যাক করা গানটি শোনেননি তারা সংবাদ মাধ্যমে দেখার পর খুঁজে বের করে তা শোনেন। আর এতে যেমন বিষয়টি আলোচিত-সমালোচিত হয় তেমনি পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ভিউ বাণিজ্য হয় আকাশচুম্বী।
সুতরাং সংগীত বাণিজ্যের এই দানবীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক দফায় কূটকৌশল খাটিয়ে তাদের আসল স্বার্থ হাসিল করে একদিকে দেশীয় সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ গানগুলোর বিকৃতি ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে অপকৌশলে সাধারণ মানুষের ধারণাতীত মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
বিষয়টি সংস্কৃতি জগতে অনেক গভীর ও সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র হলেও সরাসরি প্রতিবাদ কেউ করছে না। কেননা এসব দানবীয় প্রতিষ্ঠান অর্থ-সমপদের বিশাল পাহাড় গড়ে এ দেশের সাধারণ মানুষজনের নাগালের বাইরে তথা উচ্চ পর্যায়ে শক্ত অবস্থান নিয়ে একেবারে জেঁকে বসেছে। এদের কালো থাবা থেকে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির মৌলিকত্ব রক্ষা করতে হলে সংশ্লিষ্ট মহলের যেমন দৃষ্টি ও সদিচ্ছা জরুরি তেমনি শিল্প-সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষেরও তীব্র প্রতিবাদ অপরিহার্য।
লেখক: প্রযোজনা সহযোগী, বাণিজ্যিক কার্যক্রম, বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা