একজন দার্শনিক-কবি লিখিয়াছেন—‘মানুষ নেশা করিবেই, তবে নেশাটা যেন চমত্কার হয়।’ নেশা শব্দটির অনেক ভিন্ন প্রয়োগও রহিয়াছে। ইহাকে অনেক ক্ষেত্রে প্যাশন হিসাবেও দেখা হয়। যেমন বলা হয়, অমুকের অমুক কাজের নেশা। তমুকের বই পড়া নেশা। ইহার বাহিরে অনেক রকম নেশার কথাই আমরা বলিতে পারি। এমনকি যাহারা ভাত না খাইয়া থাকিতে পারেন না, তাহাদের ক্ষেত্রে ভাত খাওয়াটাকেও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ নেশা বলিয়া মনে করেন। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বলা হইয়াছে, এশিয়ার মানুষ, বিশেষ করিয়া তরুণ প্রজন্ম বুঁদ হইয়া রহিয়াছে আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন গ্যাজেটের মধ্যে। তাহারা ভিডিও গেম কিংবা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, টুইটারের (বর্তমানে ‘এক্স’ হ্যান্ডেল) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুঁদ হইয়া থাকে। সেইখানে তাহারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করেন। বলা যায়, একেবারেই বেকার সময় পার করেন। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সকলেই এই মাধ্যমের ঘুঁটি। একবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকিলে তাহাদের কোনো সময়জ্ঞান থাকে না। তাহারা ঐ মাধ্যমের ওয়াচটাইম বাড়াইতেছে এবং মাধ্যমটির টাইকুনদের অর্থ ইনকামের ঘুঁটিতে পরিণত হইতেছে। অথচ নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করিবার বিনিময়ে তাহারা বেকার অবস্থা হইতে উত্তরণের নূতন কোনো প্রচেষ্টায় কোয়ালিটি টাইম দিতে পারিতেছে না। উন্নত বিশ্বে আমরা দেখিতে পাই যে, মেট্রো, বাসে, ট্রেনে সকল প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একটু ফ্রি সময় পাইলেও বই পড়িতেছে। অন্যদিকে আমরা একটু সুযোগ পাইলেই মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখিতেছি। কে কী কমেন্ট করিল, কে কী রি-অ্যাক্ট করিল—বলা যায় আজাইর্যা তর্কে আমরা আন্তর্জালে হাতি-ঘোড়া মারিতেছি। আর বাপের কিংবা অভিভাবকের ঘাড়ে বসিয়া বেকার হইয়া বসিয়া রহিয়াছি।
সম্প্রতি দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়িতেছে বলিয়া জানাইয়াছে সরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানাইয়াছে, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসের তুলনায় চলতি ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার বাড়িয়াছে ৩.৫১ শতাংশ। দেশে এখন কর্মহীন লোকের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। তবে অনেকের মতে, এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। যদিও আমরা যেই নিয়ম অনুযায়ী বেকারত্বের হিসাব করি, তাহা অনেকের মতে শুভংকরের ফাঁকি। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও পদ্ধতিতে গত এক মাসে যিনি দুই-এক ঘণ্টার জন্য কর্মে ছিলেন তিনিও কর্মী, বেকার নহেন। অনেকে মনে করেন, এই ফর্মুলায় শুধু বাংলাদেশ কেন, সারা পৃথিবীতে একমাত্র দণ্ডায়মান মূর্তি ছাড়া আর কোনো বেকার খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে বেকার তাহাকেই বলে, যিনি কমপক্ষে চার সপ্তাহ ধরিয়া কর্মসন্ধানে লিপ্ত রহিয়াছেন।
দেশে কেন বাড়িতেছে বেকারের সংখ্যা—এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই অনেক কথা বলিয়া থাকেন। কিন্তু ইহাও মনে রাখিতে হইবে, নিজে চেষ্টা না করিলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা কাউকে সহযোগিতা করেন না। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা এত বেশি, অথচ তাহারা কখনো ঝুঁকি লইবেন না, ইনোভেটিভ হইবেন না; তাহারা কেবল চাকুরি, বিশেষ করিয়া সরকারি চাকুরির কাঙাল হইবেন আর বুঁদ হইয়া থাকিবেন বিভিন্ন গ্যাজেটের স্ক্রিনে। অথচ চলতি বত্সরের ২ এপ্রিল প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ম্যাক্রো পোভার্টি আউটলুক ফর বাংলাদেশ প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হইয়াছে, ২০২২-২৩ হইতে ২০২৩-২৪ অর্থবত্সরের মধ্যে প্রায় ৫ লক্ষ বাংলাদেশি নূতন করিয়া চরম দারিদ্র্যসীমায় পড়িবে। সুতরাং আমাদের কর্মক্ষম নূতন প্রজন্ম নূতন করিয়া ভাবিতে হইবে। নিজেদের উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে তরুণ ও শিক্ষিত যুবকেরা যাহাতে আগ্রহী হয়, সেই সুযোগ ও পরিবেশ তৈরি করিতে হইবে। উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রয়োজন হয় ব্যাংক ঋণের। সেই খাতটিও স্বচ্ছ হইতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে, বেকারত্বের পার্শ্বরোগ হিসাবে মাদক, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, সামাজিক বিকৃতি, ধর্ষণ, খুন, আত্মহত্যা, চেলাবৃত্তি, চাঁদাবাজি, পর্নোগ্রাফি ও মাস্তানিগিরির রমরমা অবস্থা তৈরি হয়, যাহা আমাদের সমাজের জন্য কখনো মঙ্গল বহিয়া আনে না।