বিবিসির এক প্রতিবেদনে ইউরোপ-আমেরিকায় ক্রিকেট খেলা নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম। ইউরোপে ইংল্যান্ড বাদে বাকি দেশগুলোর মানুষ ক্রিকেট কী, সেটা জানেই না। যে নেদারল্যান্ডস দল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলে, তাদের দেশের নারীরা বলছিলেন, ক্রিকেট একধরনের পোকা। ইংরেজি থেকে বাংলায় তর্জমা করলে ক্রিকেট তো আসলেই ঝিঁঝিঁ পোকার নাম। আর আমেরিকা? বেস বল, ভলিবল—এসবের দাপটে সে দেশে সকার পর্যন্ত জনপ্রিয় হতে পারেনি। এমনকি বিশ্বকাপে খেলার পরও না। আমেরিকা সকার বিশ্বকাপ নিজ দেশে আয়োজন করে এবং ফুটবলকে সবার কাছে নিতে পারেনি এখনো। আর ক্রিকেট? আমার ধারণা, ৯৯ শতাংশ আমেরিকান এর নাম জানে না। সেই আমরিকার কাছে বাংলাদেশ হেরে গেছে। শুধু হারেনি, তিন ম্যাচের সিরিজ হেরেছে বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ আইসিসি স্বীকৃত একটি টেস্ট দল।
বাংলাদেশে এখন তারকা বলতে আমরা বুঝি রাজনীতিবিদ বা ক্রিকেটার। মিডিয়া খুললেই তাদের দেখা পাবেন। ক্রিকেটের কথায় আসি। উপমহাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত আর পাকিস্তান ক্রিকেট না খেললে আমরাও খেলতাম না। যুদ্ধ আর জাতিগত বিদ্বেষের আরেক নাম ছিল এই ক্রিকেট খেলা। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট মানেই ছিল লড়াই। এখনো আছে। সেই লড়াই ২২ গজে যতটা, তার চেয়ে বেশি ছিল মানুষের মনে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু আর প্রগতিশীল মুসলমানের পছন্দের দল ভারত। বাকিরা সবাই ছিল পাকিস্তানের জন্য মরিয়া। কায়দা করে যারা পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলে, খেলায় কোনো রাজনীতি নাই, তারা আসলে আহম্মক অথবা ধুরন্ধর। রাজনীতি না থাকলে ভারত হারলে পাকিস্তানে মিষ্টি বিতরণ হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে কেন হয়? কেন পাকিস্তান হারলে আমাদের মনের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়? ক্রিকেট আর রাজনীতি উপমহাদেশে এতটাই একাকার যে একটি ছাড়া আরেকটি অচল। মনে পড়ে সেই তরুণের কথা, শচীন টেণ্ডুলকারের সমর্থনে পতাকা ওড়ানোর জন্য যাকে জেলে যেতে হয়েছিল? সেই নিরিহ যুবকটিকে মনে করি, যাকে প্রায় পিটিয়ে মারার মতো অবস্থা করেছিল দর্শক। এই সংক্রমণ আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ল বিগত কয়েক দশকে।
যখন আমাদের ক্রিকেট টিম হলো, ১১ জন খেলোয়াড় পেলাম, আনন্দের বাঁধ ভেঙে রাস্তায় নামল মানুষ। না চাইতেই আইসিসির সদস্যপদ, না খেলেই কারো আনুকূল্যে চান্স পাওয়ার পরিণাম কী হয়? যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে পদে পদে। নবীন দল বলার দিন পেরিয়ে গেছে। বরং প্রবীণ হতে হতে কারো কারো গোঁফ-দাড়ি পেকে সাদা, কিন্তু ক্রিকেট যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই। সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের বিষয়, জ্ঞানবিজ্ঞান, আর্ট কালচার সব ছাপিয়ে এই ক্রিকেটাররা হয়ে গেলেন জাতীয় হিরো। এদের ফলোয়ার অনুগামীর সংখ্যা লাখে লাখে। সাকিব আল হাসান নিঃসন্দেহে ভালো খেলোয়াড়। কিন্তু খেলা বোঝে কত জন? আসলে ক্রিকেট বোঝার মতো কত জন মানুষ আছে দেশে? প্রমীলা দর্শকের বেশির ভাগই মাঠে যায় আনন্দের জন্য। পুরুষেরা চার-ছক্কা বা কে ব্যাট করে সেটা জানলেও ডিপ ফাইন লেগ বা মিড ইউকেট চেনে না। এই না চেনা, না জানা ক্রিকেটারদের আমরা এতটাই বড় করে ফেলেছি যে, তারা এখন অনেকে অনেক বড় কিছু। আরো অনেকের মনে সেই আশা জাগরুক হয়ে গেছে।
আমেরিকার কাছে বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচ হারার পর মিডিয়া লিখছে :গতকাল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেটের সবচেয়ে আনন্দময় দিন। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে আইসিসির পূর্ণ সদস্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে দ্বিতীয় জয় এটি। স্বাভাবিকভাবেই আনন্দে মাতোয়ারা দেশটির ক্রিকেটপ্রেমীরা। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাজমুল হোসেন শান্তর দলের মুণ্ডপাত করছেন বাংলাদেশের সমর্থকেরা। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে এমন হার নিঃসন্দেহে টাইগার শিবিরের বড় ধাক্কা। অনেকটা ‘ওয়েকআপ’ কলের মতো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই হারের দায় কার? বিশ্বকাপ খেলতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে টি-টোয়েন্টি জয়ের একটা ফর্মুলা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। এতে অবশ্য তার মূল ভরসা ছিল বোলিং ইউনিট। আগে ব্যাট করলে ব্যাটাররা ১৬০-১৭০ রান করবেন। আর মিতব্যয়ী বোলিংয়ে বোলাররা ম্যাচ জেতাবেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রথম শর্তই পূরণ করতে পারেননি বাংলাদেশের ব্যাটাররা। ঘরের মাঠে সদ্য শেষ হওয়া জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে প্রথম ম্যাচে ব্যর্থ টাইগার ব্যাটাররা। এমন হারের জন্য স্বাভাবিকভাবে কাঠগড়ায় ওঠার কথা ব্যাটারদের। একই কাজ করলেন দলপতি। ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ভালো ব্যাটিং করতে না পারার আক্ষেপ ছিল শান্তর কণ্ঠে। তিনি বলেন, ‘আমরা ভালো ব্যাটিং করিনি। আমরা প্রথম দুই ওভারে ভালো শুরু করেছিলাম। কিন্তু মাঝে উইকেট হারিয়েছি। আমরা আরো ২০ রান বেশি করতে পারতাম। তাহলে ম্যাচটা অন্যরকম হতে পারত।’ ব্যাট হাতে দীর্ঘদিন ধরে রানের খরায় ভুগছেন লিটন দাস, নাজমুল হোসেন শান্ত, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও সৌম্য সরকাররা। এরা হঠাত্ একটি ম্যাচে জ্বলে ওঠেন, তারপর দীর্কালের জন্য নিভে যান। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে শুরুটা ভালো করেছিলেন লিটন। একবার জীবন পেয়েও এই ওপেনার আউট হন ব্যক্তিগত ১৪ রানে। আর টাইগার দলপতি ১১ বল খেলার পর সাজঘরে ফেরেন ২ রান করে। এমন ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরও উইকেটকে দায়ী করছেন শান্ত। দ্বিতীয় ম্যাচের কথাও সবাই জানেন এবং তাদের ম্যাচ সম্পর্কে মন্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে।
বুঝুন এবার। আমেরিকার মতো নবীন নাম না জানা দলের কাছে হারার পর যদি অধিনায়ক উইকেটকে দায়ী করেন, তো কী বলার থাকে? এখন আসলে সময় এসেছে নতুন করে ভাবার। এই ক্রিকেট যদি আমাদের জাতীয় গর্ব বা পরিচয় হয়ে থাকে, তো বিপদ আরো বাড়বে। বিদেশের মাটিতে আশা নিয়ে বসবাস করা বাংলাদেশিদের স্বপ্নভঙ্গ হবে বারবার। এটা কোনো ম্যাজিক নয় যে আগামী সব খেলায় ফাটিয়ে দেবেন আমাদের এই বীরেরা। তাঁরা প্রায়ই ধুঁকে মাঝে মাঝে সোজা হয়ে খাড়াতে পারেন। একটা সময় ফুটবল, তারপর হকি—এগুলো আশা জাগিয়েছিল। বিশেষ করে ফুটবল ছিল আকাশ সমান জনপ্রিয়। ধীরে ধীরে তারা ইতিহাসে ঠাঁই নিয়ে ফেলেছে। এখন সময় ক্রিকেটের। অনেকে বলবেন, একটি-দুটি ম্যাচে বা সিরিজে হারলেই কি এসব লিখতে হয়? জি না। একটা না, এই ব্যর্থতা ধারাবাহিক। ক্রিকেট রাজনীতি যতটা পপুলার, ক্রিকেট খেলাটা তত নয়। খেলোয়াড় থেকে কলাকুশলী, সমথর্ক—সবকিছুতেই রাজনীতি। এতে আসলে দেশের কী লাভ? কী লাভ প্রবাসের বাঙালিদের? যারা ছুটি নিয়ে ডলার-পাউন্ড খরচ করে মাঠে যায়, আর ফিরে আসে একবুক হতাশা নিয়ে?
আমার মতে, ক্রিকেটে এখন যারা তারকা, তারা থাকতে আসলেই কোনো ভরসা নাই। সেটা সাকিব হোক আর লিটন, যাদের দিন গেছে তাদের গেছে। খেলাকে মূলত খেলার জায়গায় রাখলে হয়তো ফল পাওয়া যেতে পারে। ভারতের মতো জুয়া আর উন্মাদনা কিংবা পাকিস্তানের মতো জোশের ওপর ছেড়ে দিলে ক্রিকেট নয়, থাকবে যুদ্ধ। আমেরিকার কাছে আমাদের এই হার যদি চোখ খুলতে পারে, তো খেলাধুলারই মঙ্গল হবে।
লেখক: সিডনি থেকে