সালটা সম্ভবত ২০১২ কিংবা ১৩। সাইফ কামাল তখন কাজ করছিলেন একটি ইংরেজি সংবাদপত্রের হেড অব মার্কেটিং অ্যান্ড ডিজাইন হিসেবে। সে সময় হঠাৎ একটি নতুন উদ্যোগের কথা তার মাথায় আসে। তিনি ভাবলেন, দেশের তরুণরা নিত্যনতুন স্টার্টআপের আইডিয়া নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করেন ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা তা বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হন না। এধরনের তরুণদের নিয়ে কাজ করার কথা ভেবে সাইফ গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠান ‘তরু ইনস্টিটিউট অব ইনক্লুসিভ ইনোভেশন’। প্রতিষ্ঠানটি মূলত নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য একটি ইনকিউবেটর হিসেবে কাজ করছিল। তরুণদের নিয়ে সাইফের এই উদ্যোগ বেশ সাড়া জাগায়, ধীরে ধীরে তরুর কার্যক্রমও প্রসারিত হতে থাকে। একপর্যায়ে ২০১৭ সালে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘গ্লোবাল শেপার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান সাইফ।
এ পর্যন্ত গল্পের প্রতিটি ধাপ মসৃণ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সাইফ তখনো জানতেন না, তার জীবনে কী ঝড় আসতে যাচ্ছে। দাভোসের সম্মেলনের পরপরই এক সফরে সিঙ্গাপুরে ছোটবেলার বন্ধু জামালের সঙ্গে দেখা হয় সাইফের। প্রসঙ্গক্রমে জামাল বললেন, ‘বন্ধু, আমাদের তো বয়স বাড়ছে, চল একবার হেলথ চেকআপ করিয়ে আসি।’ সাইফ এই কথায় গুরুত্ব না দিলেও পরে বন্ধুর আগ্রহে রাজি হন। যেহেতু তার কোনো অসুস্থতা ছিল না, তাই ধারণা করেন সব ফলাফল ভালো আসবে। কিন্তু বিধি বাম। কার্ডিওগ্রাম করার সময় হাসপাতালের সেবিকা বললেন, সাইফকে দ্রুত হার্ট সার্জনের শরণাপন্ন হতে হবে, ভাল্বের সমস্যা। হেলাফেলার কোনো সময় অবশিষ্ট নেই। এখনই চিকিৎসা না করা হলে মৃত্যু হতে পারে যেকোনো সময়! এরপর ভারতের ব্যাঙ্গালোরে সাইফের ওপেন হার্ট সার্জারি সম্পন্ন হয় ডা. দেবী শেঠির অধীনে, যেখানে ভাল্ব প্রতিস্থাপন করা হয়। হাফ ছেড়ে বাঁচেন সাইফ ও তার পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু বছরখানেক পর আইসিইউ-তে প্রায় দুই সপ্তাহ পর জ্ঞান ফেরে সাইফের। বুঝতে পারেন, শরীরের বাঁ দিক প্যারালাইজড হয়ে গেছে, দৃষ্টিশক্তিও হারিয়েছেন। ডাক্তাররা জানান, স্ট্রোকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মস্তিষ্কের বড় অংশ। দীর্ঘ চিকিৎসায় ধীরগতিতে সেরে উঠছিলেন সাইফ, কিন্তু শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা হয়ে পড়েছিল একেবারেই দুর্বল। এক পর্যায়ে হঠাৎ ফুসফুসের সমস্যা দেখা দেয়। অন্যদিকে বেচেট সিন্ড্রোম নামের এক বিরল রোগ ধরা পড়ে, যার কারণে রক্তনালীর প্রদাহ দেখা দেয়। এরপর করোনাকালে কোভিড-১৯ ভাইরাসেও আক্রান্ত হন। পরিচিতজনেরা ভেবেছেন, তাকে বোধহয় আর বাঁচানো সম্ভব হবে না। কিন্তু নিজের মনোবলের কারণে সাইফ হার মানেননি।
চারপাশের মানুষেরা যার যার কাজে এগিয়ে যাচ্ছেন, পৃথিবীও এগোচ্ছে দ্রুতগতিতে; অথচ অসুস্থতায় জর্জরিত হয়ে বিছানাবন্দি জীবনের এই ছন্দপতন সাইফকে প্রচণ্ড অস্থির করে তুলছিল। তবে করোনা মহামারীর সময়ের লকডাউনের স্থবিরতা তার জন্য কিছুটা স্বস্তির কারণ হয়। সেরে ওঠার সেই দিনগুলোতে ঢাকায় ঘরে বসে ভাই অনিকের সঙ্গে মেমোরি গেম খেলেছেন। থেরাপিস্টের পরামর্শ নিয়ে নতুন করে হাঁটতে ও কথা বলতে শিখেছেন। দুই ভাই মিলে রান্নাও করেছেন। এরপর শরীরের ব্যথা-যন্ত্রণা উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে সাঁতার ও অন্যান্য শরীরচর্চাও রপ্ত করে ফেলেন সাইফ।
অসুস্থতা, মহামারী ও বৈশ্বিক সংকটের প্রভাবে সাইফের ব্যবসায়িক উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেলেও এ নিয়ে তার আক্ষেপ নেই। সাইফ উচ্চতর পড়াশোনার জন্য আবেদন করে পৃথিবী বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
২০২৩ সালে হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব এডুকেশনের অধীনে লার্নিং ডিজাইন অ্যান্ড ইনোভেটিভ টেকনোলজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করার আমন্ত্রণ পান সাইফ। সম্প্রতি অর্জন করেছেন এমএসসি ডিগ্রি। হার্ভার্ডে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সেরা মেধাবী ও উদ্যমী তরুণ-তরুণীদের মাঝে নিজেকে মেলে ধরেছেন তিনি। এর আগের কয়েকটা বছরে যে সাইফকে শারীরিক বিভিন্ন জটিলতায় নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হচ্ছিল—তিনি এখন নিজের ভেতর দারুণ এক পরিবর্তন অনুভব করছেন। সাইফের ভাষ্যমতে, অনেকে বলেন, পুকুরের একটি ব্যাঙকে যদি পানি থেকে তুলে আনা হয়, ব্যাঙটি মারা যাবে। কিন্তু সত্যিটা হলো যে— ব্যাঙটি বেঁচে থাকার নতুন উপায়ও খুঁজে বের করতে পারবে। সাইফ বললেন, ‘আমরা ছোটবেলায় যা কিছু শিখি, তার ওপর নির্ভর করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিই। অথচ মধ্য বয়সে এসে আমাকে দৈনন্দিন বহু কাজও নতুন করে শিখতে হলো। শেখার এই যাত্রাটা কঠিন ছিল, কিন্তু আমি বারবার উপলব্ধি করেছি আমাদের ইচ্ছাশক্তির ক্ষমতা আসলে অনেক। যেহেতু নতুন জীবন পেয়েছি—তাই অর্জিত জ্ঞানটুকুও মানুষের জন্য কাজে লাগাব। জীবন ও মৃত্যুর মধ্যকার সীমারেখাকে কাছ থেকে দেখে এসেছেন সাইফ। কিন্তু কোনোকিছু তাকে দমাতে পারেনি। সাইফ কামালের এই অদম্য আত্মবিশ্বাসই হতে পারে আমাদের প্রেরণা।